ননীবালা বলিলেন, ‘পুলিসের কথা অনাদিবাবুকে বলেছিলুম, তিনি ভীষণ রেগে উঠলেন; বললেন-এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির দরকার নেই, তোমাদের যদি এতাই প্ৰাণের ভয় হয়ে থাকে। পাটনায় ফিরে যাও।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে আর কি করা যেতে পারে আপনিই বলুন।’
ননীবালার স্বর কাদো-কাঁদো হইয়া উঠিল, ‘আমি কি বলব, ব্যোমকেশবাবু। আপনি একটা উপায় করুন। প্রভাত ছাড়া আমার আর কেউ নেই-আমি অবলা স্ত্রীলোক–’ বলিয়া আচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিলেন।
ননীবালার চেহারা দেখিয়া যদিও কেহই তাঁহাকে অবলা বলিয়া সন্দেহ করিবে না, তবু তাঁহার হৃদয়টি যে অসহায়া রমণীর হৃদয় তাহা স্বীকার করিতে হয়। পালিত পুত্রকে তিনি গর্ভের সন্তানের মতাই ভালবাসেন এবং তাহার অমঙ্গল আশঙ্কা করিয়া অতিমাত্রায় ভীত হইয়া পড়িয়াছেন। আশঙ্কা হয়তো অমূলক, কিন্তু তবু তাহা উপেক্ষা করা যায় না।
কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ চক্ষে ননীবালার অশ্রু-বিসর্জন নিরীক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ হঠাৎ রুক্ষস্বরে বলিল, ‘ভাইপো দুটো থাকে কোথায়?
ননীবালা আচল হইতে আশান্বিত চোখ বাহির করিলেন, ‘তারা নেবুতলায় থাকে। আপনি কি–?’
‘ঠিকানা কি? কত নম্বর?’
‘তা তো আমি জানি না, প্ৰভাত জানে। আপনি কি তাদের কাছে যাবেন, ব্যোমকেশবাবু? যদি আপনি ওদের খুব করে ধমকে দেন তাহলে ওরা ভয় পাবে—’
‘আমি তাদের ধমকাতে গেলে তারাই হয়তো উল্টে আমাকে ধমকে দেবে। আমি তাদের একবার দেখব। দেখলে আন্দাজ করতে পারব তাদের মনে কিছু আছে কিনা। তাদের ঠিকানা প্রভাত জানে? প্ৰভাতের ঠিকানা, অর্থাৎ আপনাদের বাড়ির ঠিকানা কি?’
‘বাড়ির নম্বর ১৭২/২, বৌবাজার স্ট্রীট। কিন্তু সেখানে-বাড়িতে আপনি না গেলেই ভাল হয়। অনাদিবাবু—‘
‘অনাদিবাবু পছন্দ না করতে পারেন। বেশ, তাহলে। প্ৰভাতের দোকানের ঠিকানা বলুন।’
‘প্ৰভাতের দোকান–ঠিকানা জানি না–কিন্তু নাম জীবন-প্ৰভাত। ওই যে গোলদীঘির কাছে, দোরের ওপর মস্ত সাইনবোর্ড টাঙানো আছে—‘
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, ক্লান্ত শুষ্ক স্বরে বলিল, ‘বুঝেছি। আপনি এখন আসুন তাহলে। যদি কিছু খবর থাকে জানতে পারবেন।’
ননীবালা বোধ করি একটু ক্ষুন্ন হইয়াই প্রস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ একবার কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া বলিল, ‘জগতের মাঝে কত বিচিত্ৰ তুমি হে, তুমি বিচিত্ররূপিণী।’
সেদিন সায়ংকালে ব্যোমকেশ একটি শারদীয়া পত্রিকা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল, হঠাৎ পত্রিকা ফেলিয়া বলিল, ‘চল, একটু বেড়িয়ে আসা যাক।’
সম্মুখ সমর আরম্ভ হইবার পর হইতে আমরা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাহির হওয়া বন্ধ করিয়াছিলাম, নেহাৎ দায়ে না ঠেকিলে বাহির হইতাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোথায় বেড়াতে যাবে?’
সে বলিল, ‘জীবন-প্ৰভাতের সন্ধানে।’
দু’টি মোটা লাঠি যোগাড় করিয়া রাখিয়ছিলাম, হাতে লইয়া দু’জনে বাহির হইলাম। ননীবালার উপর ব্যোমকেশের মন যতাই অপ্ৰসন্ন হোক তাঁহার কাহিনী ভিতরে ভিতরে তাহাকে আকর্ষণ করিয়াছে।
গোলদীঘি আমাদের বাসা হইতে বেশি দূর নয়, সেখানে পৌঁছিয়া ফুটপাথের উপর এক পাক দিতেই মস্ত সাইনবোর্ড চোখে পড়িল। দোকানটি কিন্তু সাইনবোর্ডের অনুপাতে ছোটই বলিতে হইবে, সাইনবোর্ডের তলায় প্রায় চাপা পড়িয়া গিয়াছে। রাস্তার ধারে একটি ঘর, তাহার পিছনে একটি কুঠুরি। সদরে দ্বারের পাশে বেঁটে এবং বঙ্কিমচক্ষু গুর্খা দণ্ডায়মান।
দোকানে প্রবেশ করিলাম; শুখা একবার তির্যক নেত্রপাত করিল, কিছু বলিল না, দেখিলাম ঘরের দেয়ালগুলি কড়িকাঠ পর্যন্ত বই দিয়া ঠাসা; তাহাতে ঘরের আয়তন আরও সঙ্কীর্ণ হইয়াছে। তাকের উপর একই বই দশ বারোটা করিয়া পাশাপাশি সাজানো। বিভিন্ন প্ৰকাশকের বই, নিজের প্রকাশন বোধ হয় কিছু নাই। আমার বইও দুই তিনখানা রহিয়াছে।
কিন্তু দোকানদারকে ঘরে দেখিতে পাইলাম না, কাউন্টারে কেহ নাই।
কাউন্টারের পিছনে কুঠুরির দরজা ঈষৎ ফাঁক হইয়া আছে। ফাঁক দিয়া যতটুকু দেখা যায় দেখিলাম, তাহার মধ্যে একটি ছোট তক্তপোশ পাতা রহিয়াছে এবং তক্তপোশের উপর বসিয়া একটি যুবক হেঁট মুখে বইয়ের মলাট বাঁধতেছে। মাথার উপর আবরণহীন বৈদ্যুতিক বালব, চারিদিকে কাগজ পিজবোর্ড লেইয়ের মালসা কাগজ কাটিবার ভীষণদর্শন ছোরা প্রভৃতি ছড়ানো। তাহার মধ্যে বসিয়া যুবক তন্ময়চিত্তে মলাট বাঁধিতেছে।
ব্যোমকেশ একটু জোরে গলা খাঁকারি দিল। যুবক ঘাড় তুলিল, ছেড়া ন্যাকড়ায় আঙুলের লেই মুছতে মুছতে আসিয়া কাউন্টারের পিছনে দাঁড়াইল; কোনও প্রশ্ন করিল না, জিজ্ঞাসু নেত্ৰে আমাদের পানে চাহিয়া রহিল।
এইবার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। বাংলা দেশের শত সহস্ৰ সাধারণ যুবক হইতে তাহার চেহারায় বিশেষ কোন পার্থক্য নাই। দেহের দৈর্ঘ্য আন্দাজ সাড়ে পাঁচ ফুট, গায়ের রঙ তামাটে ময়লা; মুখ ও দেহের কাঠামো একটু শীর্ণ। ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা এখনও পুষ্ট হয় নাই; দাঁতগুলি দেখিতে ভাল কিন্তু তাহাদের গঠন যেন একটু বন্য ধরনের, হয়তো আদিম মাতৃরক্তের নিদর্শন। চোখের দৃষ্টিতে সামান্য একটু অন্যমনস্কতার আভাস, কিন্তু ইহা মনের অভিব্যক্তি নয়, চোখের একটা বিশেষ গঠনভঙ্গী। মাথার চুল ঈষৎ রুক্ষ ও ঝাঁকড়া, চুলের যত্ন নাই। পরিধানে গলার বোতামখোলা টিলা আস্তিনের পাঞ্জাবি। সব মিলিয়া যে চিত্রটি তৈয়ারি হইয়াছে তাহা নিতান্ত মামুলী এবং বিশেষত্বহীন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি জীবন-প্ৰভাতের মালিক প্রভাত কুমার রায়?’