আদিম রিপু

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘বোধহয় পেরেছি। তবে বলা যায় না‌, কিছু ভুলচুক থাকতে পারে। যেমন কেষ্ট দাসের মৃত্যুটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছিলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল‌, ছুরি আপনার অস্ত্র নয়।’

আমি বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, কি করে সব বুঝলে বল না‌, আমি তো এখনও কিছু বুঝিনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, বলছি। অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে‌, তা আমি পাটনা যাবার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন ভেবেছিলাম অনাদি হালদারের মৃত্যু সম্বন্ধে কারুরই যখন কোনও গরজ নেই‌, তখন আমারই বা কিসের মাথা ব্যথা। কিন্তু ফিরে এসে যখন দেখলাম। কেষ্ট দাসও খুন হয়েছে‌, তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। যে লোক মানুষ খুন করে নিজের জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে চায়‌, তাকে শাসন করা দরকার। যাহোক‌, এখন দেখছি। আমি ভুল করেছিলাম‌, প্রভাতবাবু কেষ্ট দাসকে খুন করেননি। আমি একটা কঠোর কর্তব্যের হাত থেকে মুক্তি পেলাম।–এবার গল্পটা শোনো। প্রভাতবাবু্‌, যদি কোথাও ভুলচুক হয়। আপনি বলে দেবেন।’

ব্যোমকেশ অনাদি হালদারের কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। বিস্ময়ের সহিত অনুভব করিলাম‌, আজকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নূতন। ব্যোমকেশ হত্যাকারীকে বন্ধুর মত ঘরে বসাইয়া হত্যার কাহিনী শুনাইতেছে‌, এরূপ ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটে নাই।

-‘অনাদি হালদার গত যুদ্ধের সময় কালাবাজারে অনেক টাকা রোজগার করেছিল। বোধহয় আড়াই লাখ কি তিন লাখ। প্রভাতবাবু্‌, আপনি ক’খানা বই বেঁধেছিলেন?’

প্ৰভাত বলিল‌, ‘ছ’খানা। প্রত্যেকটাতে চারশো নোট ছিল।’

‘অর্থাৎ দু’ লাখ চল্লিশ হাজার।–বেশ‌, ধরা যাক অনাদি হালদার পৌঁনে তিন লাখ কালো টাকা রোজগার করেছিল। প্রশ্ন উঠল‌, এ টাকা সে রাখবে কোথায়? ব্যাঙ্কে রাখা চলবে না‌, তাহলে ইনকাম ট্যাক্সের ডালকুত্তারা এসে টুটি টিপে ধরবে। অনাদি হালদার এক মতলব বার করল।

‘অনাদি হালদার যেমন পাজি ছিল‌, তেমনি ছিল তার কুচুটে বুদ্ধি। আজ পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্সের পেয়াদাকে ফাঁকি দেবার অনেক ফন্দি-ফিকির বেরিয়েছে‌, সব আমার জানা নেই। কিন্তু অনাদি হালদার যে ফন্দি বার করল‌, সেটাও মন্দ নয়; প্রথমে সে টাকাগুলো একশো টাকার নোটে পরিণত করল। সব এক জায়গায় করল না; কিছু কলকাতায়‌, কিছু দিল্লীতে‌, কিছু পাটনায়; যাতে কারুর মনে সন্দেহ না হয়।

‘পাটনায় যাবার হয়তো অন্য কোনও উদ্দেশ্যও ছিল। যাহোক‌, সেখানে সে দপ্তরীর খোঁজ নিল; প্রভাতবাবু তার বাসায় এলেন বই বাঁধতে। বিদেশে বাঙালীর ছেলে প্রভাতবাবুকে দেখে অনাদি হালদারের পছন্দ হল। এই ধরনের দপ্তরী সে খুঁজছিল‌, সে প্রভাতবাবুকে আসল কথা বলল; এও বলল যে‌, সে তাঁকে পুষ্যিপুত্তুর নিতে চায়। পুষ্যিপুত্তুর নেবার কারণ‌, এত বড় শুপ্তকথা জানবার পর প্রভাতবাবু চোখের আড়াল না হয়ে যান।

‘প্রভাতবাবু বই বেঁধে দিলেন। পুষ্যিপুত্তুর নেবার প্রস্তাব পাকাপাকি হল। অনাদি হালদার প্ৰভাতকে আর ননীবালা দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এল। নোটের বইগুলো অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আলমারিতে উঠল। স্টীলের আলমারি‌, তার একমাত্ৰ চাবি থাকে অনাদি হালদারের কোমরে। সুতরাং কেউ যে আলমারি খুলবে‌, সে সম্ভাবনা নেই। যদি-বা কোনও উপায়ে কেউ আলমারি খোলে‌, সে কী দেখবে? কতকগুলো বই রয়েছে‌, মহাভারত‌, রামায়ণ ইত্যাদি। টাকাকড়ি সামান্যই আছে। বই খুলে বইয়ের পাতা পরীক্ষা করার কথা কারুর মনে আসবে না। এছাড়া বাইরের লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে ব্যাঙ্কেও কয়েক হাজার টাকা রইল।

‘অনাদি হালদারের কলকাতার বাসায় আরও দু’জন লোক ছিল-কেষ্ট দাস আর নৃপেন। নৃপেন ছিল তার সেক্রেটারি। অনাদি হালদার ভাল লেখাপড়া জানত না‌, তাই ব্যবসার কাজ চালাবার জন্যে নৃপেনকে রেখেছিল। আর কেষ্ট দাস জোর করে তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। কেষ্ট দাস ছিল অনাদি হালদারের ছেলেবেলার বন্ধু, অনাদির অনেক কুকীর্তির খবর জানত, নিজেও তার অনেক কুকীর্তির সঙ্গী ছিল।

‘অনাদি হালদার সতেরো-আঠারো বছর বয়সে নিজের ব্যাপকে এমন প্রহার করেছিল যে‌, পরদিনই বাপটা মরে গেল। পিতৃহত্যার বীজ ছিল অনাদির রক্তে। জীবজগতে বাপ আর ছেলের সম্পর্ক হচ্ছে আদিম শত্রুতার সম্পর্ক; সেই আদিম পাশবিকতার বীজ ছিল অনাদি হালদারের রক্তে। বাপকে খুন করে সে নিরুদ্দেশ হল। আত্মীয়স্বজনেরা অবশ্য কেলেঙ্কারির ভয়ে ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দিলে।

‘অনেকদিন পরে অনাদির সঙ্গে কেষ্ট দাসের আবার দেখা; দু’জনে মিলে এক মারোয়াড়ীর ঘরে ডাকাতি করতে গেল। অনাদি মারোয়াড়ীকে খুন করে টাকাকড়ি নিয়ে ফেরারী হল‌, কেষ্ট দাস লুটের বাখরা কিছুই পেল না।

‘এবার কুড়ি বছর পরে অনাদির সঙ্গে আবার কেষ্ট দাসের কথা। অনাদি তখন বৌবাজারের বাসা নিয়ে বসেছে; কেষ্ট দাস তাকে বলল‌, তুমি খুন করেছ‌, যদি আমাকে ভরণপোষণ না কর‌, তোমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেব। নিরুপায় হয়ে অনাদি কেষ্ট দাসকে ভরণপোষণ করতে লািগল।

‘এদিকে অনাদি হালদারের দুই ভাইপো নিমাই আর নিতাই খবর পেয়েছিল যে‌, খুড়ো অনেক টাকার মালিক হয়ে কলকাতায় এসে বসেছে। তারা অনাদির কাছে যাতায়াত শুরু করল। অনাদি ভারি ধূর্ত‌, সে তাদের মতলব বুঝে কিছুদিন তাদের ল্যাজে খেলালো‌, তারপর একদিন তাড়িয়ে দিলে। নিমাই নিতাই দেখল‌, খুড়োর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায়‌, তারা খুড়োর ভাবী পুষ্যিপুত্তুরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হল না। গুখাঁ দরোয়ান দেখে তারা প্রভাতবাবুর দোকানে যাওয়া বন্ধ করল।

0 Shares