‘কিন্তু এত টাকার লোভ তারা ছাড়তে পারছিল না। কোনও দিকে কিছু না পেয়ে তারা অনাদি হালদারের বাসার সামনে হোটেলে ঘর ভাড়া করল, অষ্টপ্রহর বাড়ির ওপর নজর রাখতে লািগল। এতে অবশ্য কোনও লাভ ছিল না, কিন্তু মানুষ যখন কোনও দিকেই রাস্তা খুঁজে না পায়, তখন যা হোক একটা করেই মনকে ঠাণ্ডা। রাখে। নিমাই নিতাই পালা করে হোটেলে আসত, আর চোখে দূরবীন লাগিয়ে জানালায় বসে থাকত। অজিত, তোমার মনে আছে বোধহয়, ননীবালা যেদিন প্রথম এসেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, সর্বদাই যেন অদৃশ্য চক্ষু তাঁদের লক্ষ্য করছে। সে অদৃশ্য চক্ষু নিমাই-নিতাইয়ের।
‘যাহোক, দিন কাটছে। অনাদি হালদার জমি কিনে বাড়ি ফেদেছে। প্রভাতবাবুকে সে পুষ্যিপুকুর নেবার আশ্বাস দিয়ে এনেছিল, প্রথমটা তাঁর সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করল। তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করে দিলে; অ্যাটনীর কাছে গিয়ে পুষ্যিপুতুর নেবার বিধি-বিধান জেনে এল। কিন্তু বাঁধা-বাঁধির মধ্যে পড়বার খুব বেশি আগ্রহ তার ছিল না, সে পাকাপাকি লেখাপড়া করতে দেরি করতে লাগল। প্রভাতবাবু দোকান নিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন, ননীবালা দেবী জানেন না যে পুষ্যিপুত্তুর নিতে হলে লেখাপড়ার দরকার। তাই এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করল না।
‘তারপর এক ব্যাপার ঘটল। প্রভাতবাবু শিউলী মজুমদারকে দেখে এবং তার গান শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনি শিউলীদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলেন। দয়ালহরি মজুমদার ঘুঘু লোক, সে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারল যে প্রভাতবাবু বড়লোকের পুষ্যিপুতুর ; প্রভাতবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে তার আপত্তি হল না। দয়ালহরি মজুমদারের চালচুলো নেই, সে ভােবল ফাঁকতালে যদি মেয়ের বিয়েটা হয়ে যায়, মন্দ কি!
‘প্রভাতবাবু ননীবালা দেবীকে শিউলীর কথা বললেন। ননীবালা অনাদি হালদারকে বললেন। প্রভাতবাবুর বিয়ে দিতে অনাদি হালদারের আপত্তি ছিল না, সে বলল, মেয়ে দেখে যদি পছন্দ হয় তো বিয়ে দেব।
‘তখন পর্যন্ত অনাদি হালদারের মনে কোনও বদ-মতলব ছিল না, নেহাৎ বরকতা সেজেই সে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু শিউলীকে দেখে সে মাথা ঠিক রাখতে পারল না। মানুষের চরিত্রে যতরকম দোষ থাকতে পারে, কোনটাই অনাদি হালদারের বাদ ছিল না। সে ঠিক করল, শিউলীকে নিজে বিয়ে করবে।
‘বাসায় ফিরে এসে সে বলল, মেয়ে পছন্দ হয়নি। তারপর তলে তলে নিজে ঘটকালি আরম্ভ করল। দয়ালহরি মজুমদার দেখল, দাঁও মারবার এই সুযোগ; সে ঝোপ বুঝে কোপ মারল। অনাদি হালদারকে বলল, তুমি বুড়ো, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব কেন? তবে যদি তুমি দশ হাজার টাকা দাও—
‘এইভাবে কিছুদিন দর-কষাকষি চলল, তারপর রফা হল, অনাদি হালদার পাঁচ হাজার টাকা হ্যান্ডনেটের ওপর ধার দেবে। বিয়ের পর হ্যান্ডনোট ছিড়ে ফেলা হবে।
বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে নিয়ে অনাদি হালদার ভাবতে বসল, কি করে প্রভাতবাবুকে তাড়ানো যায়। পুষ্যিপুত্তুর নেবার আগ্রহ কোনওকালেই তার বেশি ছিল না, এখন তো তার পক্ষে প্রভাতবাবুকে বাড়িতে রাখাই অসম্ভব। প্রভাতবাবুর প্রতি তার ব্যবহার রূঢ় হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ সে তাঁকে তাড়িয়ে দিতেও পারল না। প্রভাতবাবু বইবাঁধানো নোটের কথা যদি পুলিসের কাছে ফাঁস করে দেন, অনাদি হালদারকে ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে জেলে যেতে হবে।
‘প্রভাতবাবু ভিতরের কথা কিছুই জানতেন না। সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়াতে তিনি খুবই মুষড়ে পড়লেন, তারপর ঠিক করলেন অনাদিবাবুর অমতেই শিউলীকে বিয়ে করবেন, যা হবার হবে। তিনি দয়ালহরির বাসায় গেলেন। দয়ালহরি তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে এবং জানিয়ে দিলে যে, অনাদি হালদারের সঙ্গে শিউলীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
এই পর্যন্ত বলিয়া ব্যোমকেশ থামিল। টিন হইতে সিগারেট বাহির করিতে করিতে বলিল, ‘এই হচ্ছে অনাদি হালদারের মৃত্যুর পটভূমিকা। এর মধ্যে খানিকটা অনুমান আছে, কিন্তু ভুল বোধহয় নেই। প্রভাতবাবুকি বলেন?’
প্রভাত বলিল, ‘ভুল নেই। অন্তত যতটুকু আমার জ্ঞানের মধ্যে, তাতে ভুল নেই।’ পুটরাম চা লইয়া প্রবেশ করিল।
১৮
তিনজনে নীরবে বসিয়া আদা-গন্ধী চা সেবন করিলাম। রাত্ৰি শেষ হইয়া আসিতেছে।
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ননীবালা দেবী যখন প্রথম আমার কাছে এলেন তখন সমস্ত ব্যাপারটা আমি উল্টো দিক থেকে দেখলাম। প্রভাতবাবুর জীবনের কোনও আশঙ্কা আছে কিনা এইটেই হল প্রশ্ন। ননীবালা যা বললেন তা থেকে ভয়ের কারণ আমি কিছু দেখতে পেলাম না। তবু বলা যায় না। দিনকাল খারাপ, নরহত্যা সম্বন্ধে মানুষের মন থেকে অনেক দ্বিধা সঙ্কোচ সরে গেছে ; একটা আদিম বর্বরতার মনোভাব আমাদের চেপে ধরেছে। আমি তদারক করতে বেরুলাম।
‘প্রভাতবাবুকে দেখলাম; নিমাই নিতাই, অনাদি হালদার, নৃপেন, কেষ্ট দাস, সকলকেই দেখলাম। ননীবালা আবার এলেন, তাঁকে বললাম, প্রভাতবাবুকে মেরে কারুর কোনও লাভ নেই, বরং অনাদি হালদারকে মেরে লাভ আছে। তারপর কালীপুজোর রাত্রে সত্যিই অনাদি হালদার খুন হল।
‘শেষ রাত্রে কেষ্ট দাস এসে আমাকে নিয়ে গেল। সকলের বিশ্বাস কেষ্ট দাসই খুন করেছে। আমি গিয়ে সব দেখেশুনে বুঝলাম, এ রাগের মাথায় খুন নয়, প্ল্যান করে খুন; কেষ্ট দাস যদি খুন করত তাহলে খুন করবার আগেই অনাদি হালদারের সঙ্গে ঝগড়া করত না। তাছাড়া, যত ঝগড়াই হোক, যে-হংস স্বর্ণডিম্ব প্রসব করে তাকে খুন করবে। এমন আহাম্মক কেষ্ট দাস নয়।