আদিম রিপু

‘ভেবে দেখা। নৃপেনের স্বভাবটা ছিচকে চোরের মত। সে চাবি তৈরি করেছিল‌, মতলব ছিল অনাদি হালদার যখন বাড়ি থাকবে না। তখন আলমারি খুলে দুচার টাকা সরাবে। কিন্তু সরাবার সুযোগ বোধহয় তার হয়নি। চাবিটা তার টেবিলের দেরাজে রেখেছিল। সে-রাত্রে সিনেমা থেকে ফিরে এসে যখন দেখল অনাদি হালদার খুন হয়েছে তখন সে চাবির কথা সাফ ভুলে গেল। তারপর আমি অনাদি হালদারের কোমর থেকে চাবি নিয়ে সবাইকে দেখলাম‌, তখন নৃপেনের মনে পড়ে গেল। সর্বনাশ! পুলিস এসে যদি তার দেরাজে চাবি পায় তাহলে তাকেই খুনী বলে ধরবে। সে কোনও মতে চাবিটাকে বিদেয় করবার চেষ্টা করতে লাগল এবং শেষ পৰ্যন্ত এক ফাঁকে চাবিটা জানিলা দিয়ে গলিতে ফেলে দিলে।

‘চাবিটা আমি সকালবেলা গলিতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম নৃপেন খুন করেনি। তারপর আমার বন্ধু রমেশ মল্লিকের চিঠি পেয়ে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। নৃপেন ছিঁচকে চোর‌, মানুষ খুন করবার সাহস তার নেই।

‘বাকি রইল কেষ্ট দাস আর প্রভাতবাবু।

‘সেদিন সন্ধ্যেবেলা কেষ্ট দাস এখানে এল। রাত্রে তাকে মদ খাইয়ে অনাদি হালদারের পুরনো ইতিহাস জেনে নিলাম। কেষ্ট দাসও সেদিন আমার কাছে একটা কথা জানতে পেরেছিল। আমি তাকে কথায় কথায় বলেছিলাম যে প্রভাতবাবু দপ্তরীর কাজ জানেন। কথাটা সে আগে জানত না।

‘যাহোক‌, তারপর কয়েকদিন কেটে গেল। দেখলাম নৃপেন আর কেষ্ট দাস পুরনো বাসাতেই রয়েছে। তারা যদি টাকা মেরে থাকে তাহলে পুরনো বাসা কামড়ে পড়ে আছে কেন? তাদের চলে যাবার যথেষ্ট ওজুহাত রয়েছে‌, অনাদি হালদার মরে যাবার পর ওদের বাড়িতে থাকার আর কোনও ছুতো নেই। টাকাগুলোই বা রাখল কোথায়? ব্যাঙ্কে নিশ্চয় রাখবে না‌, অন্য কোনও লোকের হাতেও দেবে না। তবে?

‘কলকাতায় ওদের অন্য কোনও আস্তানা নেই‌, যেখানে টাকা লুকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু প্রভাতবাবুর একটা আস্তানা আছে-দোকান। তিনি যদি খুন করে টাকা সরিয়ে থাকেন তাহলে টাকা লুকিয়ে রাখার কোনও অসুবিধা নেই।

‘দোকান-বইয়ের দোকান। বিদ্যুৎ চমকের মত সমস্ত ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল‌, প্রভাতবাবু পাটনায় হিসেবের খাতা বাঁধেননি‌, বেঁধেছিলেন একশো টাকার নোট-অনাদি হালদার তাঁর বাঁধানো বইগুলোকে রামায়ণ মহাভারতের সঙ্গে মিশিয়ে আলমারিতে রেখেছিল-প্রভাতবাবু অনাদি হালদারকে মারবার পর তার কোমর থেকে চাবি নিয়ে আলমারি থেকে নোটের বইগুলো বার করে নিজের দোকানে এনেছিলেন-দোকানের হাজারখানা বইয়ের মধ্যে নোটের বইগুলো প্ৰকাশ্যে সাজানো আছে-বাইরে থেকে বই দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না

‘আগাগোড়া প্লাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।

‘কিন্তু–

‘প্রভাতবাবু টাকার লোভে এমন কাজ করবেন? প্রভাতবাবুর চরিত্র যতখানি বুঝেছিলাম তাতে তাঁকে অর্থলোভী বলে মনে হয়নি। উপরন্তু অনাদি হালদারের মৃত্যুতে প্রভাতবাবুর ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি; সে বেঁচে থাকলে তাঁকে পুষ্যিপুত্তুর নেবে‌, সমস্ত সম্পত্তি পাবার সম্ভাবনা। নগদ টাকার লোভে সেই সম্ভাবনা তিনি নষ্ট করবেন?

‘তবে কি টাকাটা গৌণ‌, তার চেয়ে বড় কারণ কিছু ছিল? অনাদি হালদার শিউলীর সঙ্গে প্রভাতবাবুর বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল; কিন্তু সেটা কি এতবড় অপরাধ যে তাকে খুন করতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেরিতে পেয়েছিলাম। দয়ালহরি মজুমদারের বাসা থেকে ফেরবার সময় হঠাৎ আসল কথাটা মাথায় খেলে গিয়েছিল।

‘অনাদি হালদার এমন কাজ করেছিল যাতে নিতান্ত নিরীহ লোকেরও মাথায় খুন চেপে যায়। সে দয়ালহরিকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে নিজে শিউলীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। প্রভাতবাবুর রক্তে আগুন ধরে গেল। আগুন ধরা বিচিত্র নয়‌, আগুনের ফুলকি তাঁর রক্তের মধ্যেই ছিল।

‘আবার একটা বরফের মত ঠাণ্ডা কূট বুদ্ধি তাঁর ছিল‌, সেটাও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তিনি অনাদি হালদারকে ধনেপ্ৰাণে মারবার প্ল্যান ঠিক করলেন। বাঁটুল সর্দারকে তিনি আগে থাকতেই চিনতেন‌, রাইফেল ভাড়া করা কঠিন হল না। কালীপুজোর রাত্রে বুড়ো পাঠাকে বলি দেবার ব্যবস্থা হল।

‘সে-রাত্রে প্রভাতবাবু ননীবালা দেবীকে সিনেমায় পৌঁছে দিয়ে দোকানে গেলেন। দোকান আলো দিয়ে সাজিয়ে সাড়ে দশটার সময় আবার বেরুলেন‌, এবার একটা কাপড়ের থলি পকেটে নিলেন। দোকান খোলাই রইল‌, গুখা দরোয়ান দরজায় পাহারায় রইল।

‘বাসার কাছে এসে প্রভাতবাবু দেখলেন বাসার সামনে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। কেউ তাঁকে লক্ষ্য করল না‌, তিনি নতুন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। নতুন বাড়ির মধ্যে বাঁটুল সদর রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাঁটুল অনাদি হালদারের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না‌, সুতরাং তার এ ব্যাপারে উৎসাহ থাকাই স্বাভাবিক।

‘ছাদের ওপর তক্তা ফেলে প্রভাতবাবু বাসায় ঢুকলেন। ছাদের দরজা সম্ভবত খোলাই ছিল; না থাকলেও ক্ষতি নেই‌, তিনি দু’চারবার দরজায় নাড়া দিয়ে ছিটুকিনি খুলে ফেললেন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনাদি হালদার বাজি পোড়ানো দেখছিল‌, পিছন দিকে শব্দ শুনে সে ফিরে দাঁড়াল। প্রভাতবাবু সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলেন। গুলিটা অনাদি হালদারের শরীর ভেদ করে রাস্তার ওপারে শ্ৰীকান্ত হোটেলের জানলা দিয়ে ঢুকে দেয়ালে আটকালো। হাই ভেলসিটি মিলিটারি রাইফেল‌, তার গুলি যদি নিমাই কিম্বা নিতাইকে সামনে পেতো তাকেও ফুটো করে যেত।|

‘তারপর প্রভাতবাবু মৃতের কোমর থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুললেন। নোটের বইগুলো থলিতে পুরে‌, চাবি আবার যথাস্থানে রেখে যে পথে এসেছিলেন সেই পথে ফিরে গেলেন। বাঁটুল অপেক্ষা করছিল‌, রাইফেল নিয়ে অদৃশ্য হল। প্রভাতবাবু দোকানে ফিরে গিয়ে বইগুলো উঁচু একটা তাকে সাজিয়ে রেখে দিলেন। তারপর যথাসময়ে সিনেমায় গিয়ে মা’কে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরলেন।

0 Shares