আদিম রিপু

যুবক বলিল‌, ‘আমার নাম প্রভাত হালদার।’

‘ও-হাঁ-ঠিক কথা। আপনি যখন অনাদিবাবুর—’ ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করিল।

‘পুষ্যিপুত্তুর।’ প্রভাত নির্লিপ্তকণ্ঠে ব্যোমকেশের অসমাপ্ত কথা পূরণ করিয়া দিল‌, তারপর ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনি কে?’

‘আমাৰ নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’

প্রভাত এতক্ষণে একটু সজীব হইয়া ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর আমার দিকে দৃষ্টি ফিরাইল।

‘আপনি তাহলে অজিতবাবু?’

ব্যোমকেশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া প্রভাত আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল‌, সসন্ত্ৰম আগ্রহে বলিল‌, নমস্কার। আমি আপনার কাছে একবার যাব।’

‘আমার কাছে?’

‘হ্যাঁ। আমার একটু দরকার আছে। আপনার ঠিকানা–?’

ঠিকানা দিয়া বলিলাম‌, ‘আসবেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কী দরকার থাকতে পারে ভেবে পাচ্ছি না।ʼ

‘সে কথা তখন বলব।–তা এখন কি চাই বলুন। আমার কাছে নতুন বই ছাড়াও ভালো ভালো পুরনো বই আছে; পুরনো বই বাঁধিয়ে বিক্রি করি। সে সব বই অন্য দোকানে পাবেন না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপাতত আপনার কাছে নিমাই আর নিতাইয়ের ঠিকানা নিতে এসেছি।’

প্রভাত ব্যোমকেশের দিকে ফিরিল, কয়েকবার চক্ষু মিটিমিটি করিয়া যেন এই নূতন প্রসঙ্গ হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইল; তারপর বলিল‌, ‘নিমাই নিতাইয়ের ঠিকানা? তারা থাকে–’ প্ৰভাত ঠিকানা দিল‌, মধুবড়াল লেনের একটা নম্বর। কিন্তু আমরা কেন নিতাই ও নিমাইয়ের ঠিকানা চাই সে বিষয়ে কোনও কৌতুহল প্রকাশ করিল না।

‘ধন্যবাদ।’

‘আসুন। আমি কিন্তু একদিন যাব।’

‘আসবেন।’

দোকান হইতে বাহির হইলাম। তখনও বেশ বেলা আছে; শীতের সন্ধ্যা নারিকেল ছোবড়ার আগুনের মত ধীরে ধীরে জ্বলে‌, সহজে নেভে না। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, নিমাই নিতাইকে দেখে যাই। কাছেই তো।’ কিছুক্ষণ চলিবার পর বলিল‌, ‘প্ৰভাত নিজেই বই বাঁধে‌, পুরনো বিদ্যে ছাড়তে পারেনি। ছেলেটা কেমন যেন মেদামারা-কিছুতেই চাড় নেই।’

বলিলাম‌, ‘আমার সঙ্গে কী দরকার কে জানে?’

ব্যোমকেশ চোখ বাঁকাইয়া আমার পানে চাহিল‌, বলিল‌, ‘তা এখনও বোঝোনি? তোমার বই ছাপতে চায়। বোধ হয় প্রোথিতযশা কোন লেখক ওকে বই দেননি। এখন তুমি ভরসা।’

বলিলাম‌, ‘প্রেথিতযশা নয়-প্রথিতযশা।’

সে মুখ টিপিয়া হাসিল; বুঝিলাম ভুলটা ইচ্ছাকৃত। বলিলাম‌, যাহোক‌, তবু ওর বই ছাপার দিকে ঝোঁক আছে। লেখাপড়া না জানলেও সাহিত্যের কদর বোঝে। সেটা কম কথা নয়।’

ব্যোমকেশ খানিক চুপ করিয়া রহিল‌, তারপর যেন বিমনাভাবে বলিল‌, ‘প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী‌, খাসা তোর চ্যাঁচানি।’

আজকাল ব্যোমকেশ আচমকা এমন অসংলগ্ন কথা বলে যে তাহার কোনও মানে হয় না।

মধু বড়ালের গলিতে উপস্থিত হইলাম। গলিটি আজকার নয়‌, বোধ করি জব চার্নকের সমসাময়িক। দু’ পাশের বাড়িগুলি ইষ্টক-দস্তুর‌, পরস্পরের গায়ে ঠেস দিয়া কোনওক্রমে খাড়া আছে।

একটি বাড়ির দরজার মাথায় নম্বর দেখিয়া বুঝিলাম। এই বাড়ি। জীৰ্ণ বটে। কিন্তু বাঁধানো-দাঁত চুলে-কলাপ-দেওয়া বৃদ্ধের মত বাহিরের ঠাট বজায় রাখিবার চেষ্টা আছে। সদর দরজা একটু ফাঁক হইয়া ছিল‌, তাহার ভিতর দিয়া সরু গলির মত একটা স্থান দেখা গেল। লোকজন কেহ নাই।

আমাকে অনুসরণ করিতে ইঙ্গিত করিয়া ব্যোমকেশ ভিতরে প্রবেশ করিল। সুড়ঙ্গের মত পথটি যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেখানে ডান দিকে একটি ঘরের দরজা। আমরা দরজার সামনে গিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম।

আবছায়া একটি ঘর। তাহাতে অসংখ্য আসবাব ঠাসা‌, আলমারি টেবিল চেয়ার সোফা তক্তপোশ‌, নড়িবার ঠাঁই নাই। সমস্ত আসবাব পুরনো‌, একটিরও বয়স পঞ্চাশের কম নয়; দেখিলে মনে হয় ঘরটি পুরাতন আসবাবের গুদাম। তাহার মাঝখানে রঙ-চটা জাজিম-পাতা তক্তপোশের উপর বসিয়া দুইটি মানুষ বন্দুক পরিষ্কার করিতেছে। দুনলা ছররা বন্দুক‌, কুঁদার গায়ে নানাপ্রকার চিত্রবিচিত্র আঁকা দেখিয়া মনে হয় বন্দুকটিও সাবেক আমলের। একজন তাহার যন্ত্রে তেল লাগাইতেছে‌, অন্য ব্যক্তি নলের ভিতর গজ চালাইয়া পরিষ্কার করিতেছে।

মানুষ দু’টির চেহারা একরকম‌, বয়স একরকম‌, ভাবভঙ্গী একরকম; একজনের বর্ণনা করিলে দু’জনের বর্ণনা করা হইয়া যায়। বয়স ত্ৰিশের আশে পাশে‌, দোহারা ভারী গড়নের নাডুগোপাল চেহারা‌, মেটে মেটে রঙ‌, চোখের চারিপাশে চর্বির বেষ্টনী মুখে একটা মোঙ্গলীয় ভাব আনিয়া দিয়াছে‌, মাথার চুল ছোট এবং সমান করিয়া ছাঁটা। পরিধানে লুঙ্গি ও ফতুয়া। তফাত যে জুলাই তা নয়‌, কিন্তু যৎসামান্য। ইহরাই যে নিমাই নিতাই তাহাতে তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।

আমরা দ্বার পর্যন্ত পৌঁছিতেই তাহারা একসঙ্গে চোখ তুলিয়া চাহিল। দুই জোড়া ভয়ঙ্কর চোখের দৃষ্টি আমাদের যেন ধাক্কা দিয়া পিছনে ঠেলিয়া দিল। তারপর যুগপৎ প্রশ্ন হইল‌, ‘কি চাই?’

কড়া সুর‌, শিষ্টতার লেশমাত্র তাহাতে নাই। আমি অসহায়ভাবে ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিলাম। ব্যোমকেশ সহজ সৌজন্যের সহিত বলিল‌, ‘এটা কি অনাদি হালদারের বাড়ি?’

ক্ষণকালের জন্য দুই ভাই যেন বিমূঢ় হইয়া গেল। পরস্পরের প্রতি সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করিয়া সমস্বরে বলিয়া উঠিল‌, ‘না।’

ব্যোমকেশ আবার প্রশ্ন করিল‌, ‘অনাদিবাবু এখানে থাকেন না?’

কড়া উত্তর—‘না।’

ব্যোমকেশ যেন লজ্জিত হইয়া বলিল‌, ‘দেখছি ভুল ঠিকানা পেয়েছি। এ বাড়িতে কি অনাদিবাবুর কোনও আত্মীয় থাকেন? আপনারা কি–’

দুই ভাই আবার দৃষ্টি বিনিময় করিল। একজন বলিল‌, ‘সে খবরে কী দরকার?’

‘দরকার এই যে‌, আপনারা যদি তাঁর আত্মীয় হন তাহলে তাঁর ঠিকানা দিতে পারবেন।’

0 Shares