উত্তর হইল, ‘এখানে কিছু হবে না। যেতে পারেন।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্থির নেত্রে তাঁহাদের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর একটু বাঁকা সুরে বলিল, ‘আপনাদের বন্দুক আছে দেখছি। আশা করি লাইসেন্স আছে।’
আমরা ফিরিয়া চলিলাম। দুই ভ্রাতার নির্নিমেষ দৃষ্টি আমাদের অনুসরণ করিল।
বাহিরে আসিয়া হাফ ছাড়িলাম—’কি অসভ্য লোক দুটো।’
বাসার দিকে ফিরিয়া চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘অসভ্য নয়, সাবধানী। এখানে এক জাতের লোক আছে তারা কলকাতার পুরনো বাসিন্দা; আগে বড় মানুষ ছিল, এখন অবস্থা পড়ে গেছে; নিজেদের উপার্জনের ক্ষমতা নেই, পূর্বপুরুষেরা যা রেখে গিয়েছিল। তাই আঁকড়ে বেঁচে আছে। পচা বাড়ি ভাঙা আসবাব ছেড়া কাঁথা নিয়ে সাবেক চাল বজায় রাখবার চেষ্টা করছে। তাদের সাবধানতার অস্ত নেই; বাইরের লোকের সঙ্গে মেশে না, পাশে ছেড়া কাঁথাখানি কেউ ফাঁকি দিয়ে নেয়। দু-চারটি সাবেক বন্ধু ও আত্মীয় ছাড়া কারুর সঙ্গে ওরা সম্পর্ক রাখে না; কেউ যদি যেচে আলাপ করতে যায়, তাকে সন্দেহ করে, ভাবে বুঝি কোনও কু-মতলব আছে। তাই অপরিচিত লোকের প্রতি ওদের ব্যবহার স্বভাবতাই রূঢ়। ওরা একসঙ্গে ভীরু এবং কটুভাষী, লোভী এবং সংযমী। ওরা অদ্ভুত জীব।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ দু’টি ভাইকে কেমন দেখলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ননীবালা দেবী মিথ্যা বলেননি। এক জোড়া বেড়াল; তবে শুকনো বেড়াল নয়, ভিজে বেড়াল।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ওদের দ্বারা প্ৰভাতের অনিষ্ট হতে পারে তোমার মনে হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘরের বেড়াল বনে গেলে বন-বেড়াল হয়। স্বার্থে ঘা লাগলে ওরাও নিজ মূর্তি ধারণ করতে পারে।’
সন্ধ্যা ঘন হইয়া আসিতেছে, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। আমরা দ্রুত বাসার দিকে অগ্রসর হইলাম।
৩
পরদিন সকালবেলা ব্যোমকেশ সংবাদপত্র পাঠ শেষ করিয়া কিছুক্ষণ ছটফট করিয়া বেড়াইল, তারপর বলিল, ‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ। চল, অনাদি হালদারকে দর্শন করে আসা যাক। ভাইপোদের দর্শন পেলাম, আর খুড়োকে দর্শন করলাম না, সেটা ভাল দেখায় না।’
বলিলাম, ‘ভাইপোদের কাছে তো খুড়োর ঠিকনা চেয়েছিল। খুড়োর কাছে কি চাইবে?’
ব্যোমকেশ হাসিল, ‘একটা কিছু মাথায় এসেই যাবে।’
বেলা সাড়ে নটা নাগাদ বাহির হইলাম। বৌবাজারের নম্বরের ধারা কোনদিক হইতে কোনদিকে গিয়াছে জানা ছিল না, নম্বর দেখিতে দেখিতে শিয়ালদহের দিকে চলিয়াছি। কিছুদূর চলিবার পর ফুটপাথে বাঁটুল সর্দারের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘কি বাঁটুল, এ পাড়াটাও কি তোমার এলাকা?’
বাঁটুল তৈলাক্ত মুখে কেবল হাসিল, তারপর পাল্টা প্রশ্ন করিল, ‘আপনারা এ পাড়ায় এলেন যে কর্তা? কিছু দরকার আছে নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। —১৭২/২ নম্বরটা কোনদিকে বলতে পার?’
বাঁটুলের চোখে চকিত সতর্কতা দেখা দিল। তারপর সে সামলাইয়া লইয়া বলিল, ‘১৭২/২ নম্বর? ওই যে নতুন বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, ওর পাশেই।’
আমরা আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম। কিছুদূর গিয়া ফিরিয়া দেখি বাঁটুল তখনও ফুটপাথে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি তাকাইয়া আছে, আমাকে ফিরিতে দেখিয়া সে উল্টা মুখে চলিতে আরম্ভ করিল।
আমি বলিলাম, ‘ওহে, ব্যোমকেশ, বাঁটুল–’
সে বলিল, ‘লক্ষ্য করেছি। বোধ হয়। ওদের চেনে।’
আরও খানিকদূর অগ্রসর হইবার পর নূতন বাড়ির সম্মুখীন হইলাম। চারিদিকে ভারা বাঁধা, মিস্ত্রীরা গাঁথুনির কাজ করিতেছে। একতলার ছাদ ঢালা হইয়া গিয়াছে, দোতলার দেয়াল গাঁথা হইতেছে। সম্মুখে কনট্রাকটরের নাম লেখা প্ৰকাণ্ড সাইনবোর্ড। কনট্রাকটরের নাম গুরুদত্ত সিং। সম্ভবত শিখ।
বাড়ি পার হইয়া একটি সঙ্কীর্ণ ইট-বাঁধানো গলি, গলির ওপারে ১৭২/২ নম্বর বাড়ি। দোতলা বাড়ি, সদর দরজার পাশে সরু এক ফালি দাওয়া; তাহার উপরে তাঁহারই অনুরূপ রেলিং-ঘেরা ব্যালকনি। নীচের দাওয়ায় বসিয়া এক জীর্ণকায় পালিতকেশ বৃদ্ধ থেলো অঁকায় তামাক টানিতেছেন। আমাদের দেখিয়া তিনি হাঁকা হইতে ওষ্ঠাধর বিমুক্ত না করিয়াই চোখ বাঁকাইয়া চাহিলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা কি অনাদি হালদারের বাসা?’
বৃদ্ধ হুঁকার ছিদ্র হইতে অধর বিচ্ছিন্ন করিয়া খিঁচাইয়া উঠিলেন, ‘কে অনাদি হালদার আমি কি জানি! এ আমার বাসা-নীচের তলায় আমি থাকি।’
ব্যোমকেশ বিনীত স্বরে বলিল, ‘আর ওপরতলায়?’
বৃদ্ধ পূর্ববৎ খিঁচাইয়া বলিলেন, ‘আমি কি জানি! খুঁজে নাও গে। অনাদি হালদার! যত সব–’ বৃদ্ধ আবার হুঁকায় অধরোষ্ঠ জুড়িয়া দিলেন।
বৃদ্ধ হঠাৎ এমন তেরিয়া হইয়া উঠিলেন কেন বোঝা গেল না। আমরা আর বাক্যব্যয় না। করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। লম্বাটে গোছের একটি ঘর, তাহার একপাশে একটি দরজা, বোধ হয় নীচের তলার প্রবেশদ্বার; অন্য দিকে এক প্রস্থ সিঁড়ি উপরে উঠিয়া গিয়াছে।
আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিব। কিনা ইতস্তত করিতেছি, এমন সময় সিঁড়িতে দুম দুম শব্দ শুনিয়া চোখ তুলিয়া দেখি, ইয়া-লম্বা-চওড়া এক সর্দারজী বাঁকের মোড় ঘুরিয়া নামিয়া আসিতেছেন। অনাদি হালদারের বাসা সম্বন্ধে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কারণ ইনি নিশ্চয় কনট্রাকটর গুরুদত্ত সিং। তাঁহার পরিধানে মখমলী করুডুরয়ের পাৎলুন ও গ্যাবারডিনের কোট, দাড়ি বিনুনি করা, মাথায় কান-চাপা পাগড়ি। দুই বাহু মুগুরের মত ঘুরাইতে ঘুরাইতে তিনি নামিতেছেন, চক্ষু দু’টিও ঘুরিতেছে। আরও কাছে আসিলে তাঁহার দাড়ি-গোঁফে অবরুদ্ধ বাক্যগুলিও আমাদের কর্ণগোচর হইল। বাক্যগুলি বাঙলা নয়, কিন্তু তাহার ভাবাৰ্থ বুঝিতে কষ্ট হইল–’বাংগালী আমার টাকা দেবে না! দেখে নেব কত বড় অনাদি হালদার, গলা টিপে টাকা আদায় করব। আমিও পাঞ্জাবী, আমার সঙ্গে লারে-লাপপা চলবে না—’ সর্দারজী সবেগে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।