আদিম রিপু

ব্যোমকেশ আমার পানে চাহিয়া একটু হাসিল‌, নিম্নস্বরে বলিল‌, ‘অনাদিবাবু দেখছি জনপ্রিয় লোক নয়। এস‌, দেখা যাক।’

সিঁড়ির উর্ধপ্ৰান্তে একটি দরজা‌, ভিতর দিকে অৰ্গলবদ্ধ। ব্যোমকেশ কড়া নাড়িল।

অল্পকাল পরে দরজা একটু ফাঁক হইল‌, ফাঁকের ভিতর দিয়া একটি মুখ বাহির হইয়া আসিল। ভোটুকি মাছের মত মুখ‌, রাঙা রাঙা চোখ‌, চোখের নীচের পাতা শিথিল হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে। শিথিল অধরের ফাঁকে নীচের পাটির দাঁতগুলি দেখা যাইতেছে।

রাত্রিকালে এরূপ অবস্থায় এই মুখখানি দেখিলে কি করিতাম বলা যায় না‌, কিন্তু এখন একবার চমকিয়া স্থির হইলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনাদিবাবু-?’

মুখটিতে হাসি ফুটিল‌, চোয়ালের অসংখ্য দাঁত আরও প্রকটিত হইল। ভাঙা ভাঙা গলায় ভেন্টুকি মাছ বলিল‌, ‘না‌, আমি অনাদিবাবু নই‌, আমি কেষ্টবাবু। আপনারাও পাওনাদার নাকি?’

‘না‌, অনাদিবাবুর সঙ্গে আমাদের একটু কাজ আছে।’

এই সময় ভেটকি মাছের পশ্চাতে আর একটি দ্রুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল,–’কেষ্টবাবু্‌, সরুন সরুন—’

কেষ্টবাবুর মুণ্ড অপসৃত হইল‌, তৎপরিবর্তে দ্বারের সম্মুখে একটি যুবককে দেখা গেল। ডিগডিগে রোগা চেহারা‌, লম্বা ভূঁচালো চিবুক‌, মাথার কড়া কোঁকড়া চুলগুলি মাথার দুই পাশে যেন পাখা মেলিয়া আছে। মুখে একটা চটপটে ভাব।

‘কি চান আপনারা?’

‘অনাদিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘কিছু দরকার আছে কি? অনাদিবাবু বিনা দরকারে কারুর সঙ্গে দেখা করেন না।’

‘দরকার আছে বৈ কি! পাশে যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে সেটা বোধ হয় তাঁরই। ওই বাড়ি সম্বন্ধে কিছু জানিবার আছে। আপনি-?’

‘আমি অনাদিবাবুর সেক্রেটারি। আপনারা একটু বসুন‌, আমি খবর দিচ্ছি। এই যে‌, ভেতরে বসুন।’

আমরা সিঁড়ি হইতে উঠিয়া ঘরে প্রবেশ করিলাম। যুবক চলিয়া গেল।

ঘরটি নিরাভরণ‌, কেবল একটি কেঠো বেঞ্চি আছে। আমরা বেঞ্চিতে বসিয়া চারিদিকে চাহিলাম। সিঁড়ির দরজা ছাড়া ঘরে আরও গুটিতিনেক দরজা আছে‌, একটি দিয়া সদরের ব্যালকনি দেখা যাইতেছে‌, অন্য দুইটি ভিতর দিকে গিয়াছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর দেখিলাম ভিতর দিকের একটি দরজা একটু ফাঁক করিয়া একটি স্ত্রীলোক উঁকি মারিল। চিনিতে কষ্ট হইল না-ননীবালা দেবী। তিনি বোধ হয় রান্না করিতেছিলেন, বাহিরে লোক আসার সাড়া পাইয়া খুন্তি হাতে তদারক করিতে আসিয়াছেন। আমাদের দেখিয়া তিনি সভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন। ব্যোমকেশ নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া তাঁহাকে অভয় দিল। ননীবালা ধীরে ধীরে সরিয়া গেলেন।

অন্য দরজা দিয়া যুবক বাহির হইয়া আসিল।

‘আসুন।’

যুবকের অনুগামী হইয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। একটি ঘরের দরজা ঠেলিয়া যুবক বলিল‌, ‘এই ঘরে অনাদিবাবু আছেন‌, আপনারা ভিতরে যান।’

ঘরে ঢুকিয়া প্রথমটা কিছু ঠাহর হইল না। ঘরে আলো কম‌, আসবাব কিছু নাই‌, কেবল এক কোণে গদির উপর ফরাস পাতা। ফরাসের উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া একটি লোক আমাদের দিকে তাকাইয়া আছে। আধা অন্ধকারে মনে হইল একটা ময়াল সাপ কুণ্ডলী পাকাইয়া অনিমেষ চক্ষে শিকারকে লক্ষ্য করিতেছে।

চক্ষু অভ্যস্ত হইলে বুঝিলাম‌, ইনিই অনাদি হালদার বটে; ভাইপোদের সঙ্গে চেহারার সাদৃশ্য খুবই স্পষ্ট। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ; বেঁটে মজবুত চেহারা‌, চোখে মেন্দমণ্ডিত মোঙ্গলীয় বক্রতা। গায়ে বেগুনি রঙের বাল্যাপোশ জড়ানো।

আমরা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিলাম। অনাদিবাবু স্তিমিত নেত্ৰে চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিবার পর ব্যোমকেশ নিজেই কথা কহিল‌, ‘আমরা একটু কাজে এসেছি। ইনি অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়‌, পূর্ববঙ্গ থেকে সম্প্রতি এসেছেন‌, কলকাতায় বাড়ি কিনে বাস করতে চান।’

অনাদিবাবু এবার কথা বলিলেন। আমাদের বসিতে বলিলেন না‌, স্বভাব-রুক্ষ স্বরে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘তুমি কে?’

ব্যোমকেশের চক্ষু প্রখর হইয়া উঠিল‌, কিন্তু সে সহজভাবে বলিল‌, ‘আমি এঁর এজেন্ট। জানতে পারলাম আপনি পাশেই বাড়ি তৈরি করাচ্ছেন‌, ভাবলাম হয়তো বিক্রি করতে পারেন। তাই—’

অনাদিবাবু বলিলেন, ‘আমি নিজে বাস করব বলে বাড়ি তৈরি করাচ্ছি, বিক্রি করবার জন্যে নয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা তো বটেই। তবে আপনি ব্যবসাদার লোক‌, ভেবেছিলাম লাভ পেলে ছেড়ে দিতে পারেন।’

‘আমি দালালের মারফতে ব্যবসা করি না।’

‘বেশ তো‌, আপনি অজিতবাবুর সঙ্গে কথা বলুন‌, আমি সরে যাচ্ছি।’

‘না‌, কারুর সঙ্গে বাড়ির আলোচনা করতে চাই না। আমি বাড়ি বিক্রি করব না। তোমরা যেতে পারো।’

অতঃপর আর দাঁড়াইয়া থাকা যায় না। এই অত্যন্ত অশিষ্ট লোকটার সঙ্গ আমার অসহ্য বোধ হইতেছিল‌, কিন্তু ব্যোমকেশ নির্বিকার মুখে বলিল‌, ‘কিছু মনে করবেন না‌, বাড়িটা তৈরি করাতে আপনার কত খরচ হবে বলতে বাধা আছে কি?’

অনাদিবাবুর রুক্ষ স্বর আরও কর্কশ হইয়া উঠিল‌, ‘বাধা আছে।–ন্যাপা! ন্যাপা! বিদেয় কর‌, এদের বিদেয় কর—’

সেক্রেটারি যুবকের নাম বোধ করি ন্যাপা‌, সে দ্বারের বাহিরেই দাঁড়াইয়া ছিল‌, মুণ্ড বাড়াইয়া ত্বরান্বিত স্বরে বলিল‌, ‘আসুন‌, চলে আসুন–’

মানসিক গলা-ধাক্কা খাইয়া আমরা বাহিরে আসিলাম। যুবক সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিল‌, একটু লজ্জিত হ্রস্বকণ্ঠে বলিল‌, ‘কিছু মনে করবেন না‌, কর্তার আজ মেজাজ ভাল নেই।’

ব্যোমকেশ তাচ্ছিল্যুভরে বলিল‌, ‘কিছু না। —এস অজিত।’

রাস্তায় বাহির হইয়া আসিলাম। ব্যোমকেশ মুখে যতাই তাচ্ছিল্য দেখাক‌, ভিতরে ভিতরে উষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে তাহা তাহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর সে আমার দিকে চাহিয়া ক্লিষ্ট হাসিল‌, বলিল‌, ‘দুরকম ছোটলোক আছে-অসভ্য ছোটলোক আর বজাত ছোটলোক। যারা বজাত ছোটলোক তারা শুধু পরের অনিষ্ট করে; আর অসভ্য ছোটলোক নিজের অনিষ্ট করে।’

0 Shares