জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘অনাদি হালদার কোন শ্রেণীর ছোটলোক?’
‘অসভ্য এবং বজ্জাত দুইই–।’
সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু দিবানিদ্ৰা দিব। কিনা ভাবিতেছি, দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখি ননীবালা দেবী।
ননীবালা শঙ্কিত মুখ লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। ব্যোমকেশ ইজিচেয়ারে ঝিমাইতেছিল, উঠিয়া বসিল। ননীবালা বলিলেন, ‘আজ আপনাদের ও-বাড়িতে দেখে আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে গেছল, অনাদিবাবু যদি জানতে পারেন যে আমি-’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসুন। অনাদিবাবুর জািনবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আমরা গিয়েছিলাম তাঁর নতুন বাড়ির খরিদ্দার সেজে। সে যাক, আপনি এখন একটা কথা বলুন তো, অনাদি হালদার কি রকম লোক? সোজা স্পষ্ট কথা বলবেন, লুকোছাপার দরকার নেই।’
ননীবালা কিছুক্ষণ ড্যাবডেবে চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যার মত শব্দের স্রোত তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল,–’কি বলব আপনাকে, ব্যোমকেশবাবু-চামার! চামার! চোখের চামড়া নেই, মুখের রাশ নেই। একটা মিষ্টি কথা ওর মুখ দিয়ে বেরোয় না, একটা পয়সা ওর ট্যাক থেকে বেরোয় না। টাকার আন্ডিল, কিন্তু আঙুল দিয়ে জল গলে না। এদিকে উন থেকে চুন খসলে আর রক্ষে নেই, দাঁতে ফেলে চিবোবে। আগে একটা বামুন ছিল, আমি আসবার পর সেটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে; এই দেড় বছর হাঁড়ি ঠেলে ঠেলে আমার গতরে আর কিছু নেই। কি কুক্ষণে যে প্রভাতকে ওর পুষ্যিপুভুর হতে দিয়েছিলুম! যদি উপায় থাকত হতচ্ছাড়া মিনিসের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে পাটনায় ফিরে যৌতুম।’ এই পর্যন্ত বলিয়া ননীবালা রণক্লান্ত যোদ্ধার মত হাঁপাইতে লাগিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কতকটা এইরকমই আন্দাজ করেছিলাম। প্ৰভাতের সঙ্গে ওর ব্যবহার কেমন?’
ননীবালা একটু থমকিয়া বলিলেন, ‘প্ৰভাতকে বেশি ঘটায় না। তাছাড়া প্ৰভাত বাড়িতে থাকেই বা কতক্ষণ। সকাল আটটায় দোকানে বেরিয়ে যায়, দুপুরবেলা আধঘণ্টার জন্য একবারটি খেতে আসে, তারপর বাড়ি ফেরে একেবারে রাত নটায়। বুড়োর সঙ্গে প্রায় দেখাই হয় না।’
‘বুড়ো দোকানের হিসেবপত্র দেখতে চায় না?’
‘না, হিসেব চাইবার কি মুখ আছে, দোকান যে প্ৰভাতের নামে। বুড়ো প্ৰথম প্রথম খুব ভালমানুষী দেখিয়েছিল। প্রভাতকে জিজ্ঞেস করল—কী কাজ করবে? প্রভাত বলল—বইয়ের দোকান করব। বুড়ো অমনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করে দিলে।’
‘হুঁ। ন্যাপা কে? বুড়োর সেক্রেটারি?’
ননীবালা মুখ বাঁকাইয়া বলিলেন, ‘সেক্রেটারি না। আরও কিছু-বাজার সরকার। ফাড়ফড় করে ইংরিজি বলতে পারে তাই বুড়ে ওকে রেখেছে। বুড়ো নিজে একবৰ্ণ ইংরিজি জানে না, ব্যবসার কথাবার্তা ওকে দিয়ে করায়, চিঠিপত্র লেখায়। তাছাড়া বাজার করায়, হাত-পা টেপায়। সব করে ন্যাপা।’
‘ভারি কাজের লোক দেখছি।’
‘ভারি ধূর্তু লোক, নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। দু’পাতা ইংরেজি পড়েছে কিনা।’
বুঝিলাম, প্রভাত ইংরেজি জানে না, ন্যাপা ইংরিজি জানে তাই ননীবালা তাহার প্রতি প্ৰসন্ন নয়।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আর কেষ্টবাবু? তিনি কে?’
‘তিনি কে তা কেউ জানে না। বুড়োর আত্মীয় কুটুম্ব নয়, জাত আলাদা। আমরা আসবার আগে থাকতে আছে। মাতাল, মদ খায়।’
‘তাই নাকি? নিজের পয়সাকড়ি আছে বুঝি?’
‘কিছু নেই। বুড়ো জুতো জামা দেয়। তবে পরে।’
‘তবে মন্দ পায় কোথা থেকে?’
‘মদের পয়সাও বুড়ো দেয়।’
‘আশ্চর্য! এদিকে বলছেন আঙুল দিয়ে জল গলে না–’
‘কি জানি, ব্যোমকেশবাবু্, আমি কিছু বুঝতে পারি না। মনে হয়। বুড়ো ভয় করে। কেষ্টবাবু মাঝে মাঝে মদ খেয়ে মেজাজ দেখায়, বুড়ো কিন্তু কিছু বলে না।’
‘বটে।’ ব্যোমকেশ চিন্তাচ্ছন্ন হইয়া পড়িবার উপক্ৰম করিল।
ননীবালা তখন সাগ্রহে বলিলেন, কিন্তু ওদিকের কি হল, ব্যোমকেশবাবু? নিমাই নিতাইকে দেখতে গিছলেন নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গিয়েছিলাম। ওরা লোক ভাল নয়। খুড়ো আর ভাইপোদের এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায় দ্যাখ। উচ্ছের ঝাড়, ঝাড়ে মূলে তেতো।’
ননীবালা ভীতিকণ্ঠে বলিলেন, ‘তবে কি হবে? ওরা যদি প্ৰভাতকে–।’
ব্যোমকেশ ধীরস্বরে বলিল, ‘ওরা প্রভাতকে ভালবাসে না, তার অনিষ্ট চিন্তাও করতে পারে। কিন্তু আজকালকার এই অরাজকতার দিনেও একটা মানুষকে খুন করা সহজ কথা নয়, নেহাৎ মাথায় খুন না চাপলে কেউ খুন করে না। নিমাই আর নিতাইকে দেখে মনে হয় ওরা সাবধানী লোক, খুন করে ফাঁসির দড়ি গলায় জড়াবে এমন লোক তারা নয়। আর একটা কথা ভেবে দেখুন। অনাদি হালদার যদি পুষ্যিপুকুর নেবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাহলে একটা পুষ্যিপুত্তুরকে মেরে লাভ কি? একটা গেলে অনাদি হালদার আর একটা পুষ্যিপুত্তুর নিতে পারে, নিজের সম্পত্তি উইল করে বিলিয়ে দিতে পারে। এ অবস্থায় খুন-খারাপ করতে যাওয়া তো ঘোর বোকামি। বরং–’
ননীবালা বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করিলেন, ‘বরং কী?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বরং অনাদিবাবুর ভালমন্দ কিছু হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়।’
ননীবালা কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করিলেন, মনে হইল। এই সম্ভাবনার কথা তিনি পূর্বে চিন্তা করেন নাই। তারপর তিনি উৎসুক মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘তাহলে প্ৰভাতের কোনও ভয় নেই?
‘আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, এ ধরনের বোকামি নিমাই নিতাই করবে না। তবু সাবধানের মার নেই। আমি একটা প্ল্যান ঠিক করেছি, এমনভাবে ওদের কড়কে দেব যে ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে সাহস করবে না।
‘কি-কি প্ল্যান ঠিক করেছেন, ব্যোমকেশবাবু?’