আদিম রিপু

‘সে আপনার শুনে কি হবে। আপনি আজ বাড়ি যান। যদি বিশেষ খবর কিছু থাকে আমাকে জানাবেন।’

ননীবালা তখন গদগদ মুখে ব্যোমকেশকে প্রচুর ধন্যবাদ জানাইয়া প্ৰস্থান করিলেন। অনাদি হালদারের দ্বিপ্রহরে দিবানিদ্রা দিবার অভ্যাস আছে, সেই ফাঁকে ননীবালা বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছেন; বুড়া যদি জাগিয়া উঠিয়া দেখে তিনি বহিৰ্গমন করিয়াছিলেন তাহা হইলে কৈফিয়তের ঠেলায় ননীবালাকে অন্ধকার দেখিতে হইবে।

অতঃপর আমি ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, কী প্ল্যান ঠিক করেছ? আমাকে তো কিছু বলনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বাড়িতে পোস্টকার্ড আছে?’

‘আছে।’

‘বেশ‌, পোস্টকার্ড নাও‌, একখানা চিঠি লেখ। শ্ৰীহরিঃ শরণং লিখতে হবে না‌, সম্বোধনেরও দরকার নেই। লেখ–’আমি তোমাদের উপর নজর রাখিয়াছি।’–ব্যাস‌, আর কিছু না। এবার নিমাই কিংবা নিতাই হালদারের ঠিকানা লিখে চিঠিখানা পাঠিয়ে দাও।’

কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে।

ননীবালা আর আসেন নাই। প্রভাত ঘটিত ব্যাপার অঙ্কুরেই শুকাইয়া গিয়াছে মনে হয়। কেবল বাঁটুল সদরের সঙ্গে একবার দেখা হইয়াছিল। বাঁটুল আসিয়াছিল একটি রিভলবার আমাদের গছাইবার জন্য। উচিত মূল্যে পাইলে হয়তো কিনিতাম‌, কিন্তু ছয়শত টাকা দিয়া ফ্যাসাদ কিনিবার শখ আমাদের ছিল না। ব্যোমকেশ বাঁটুলকে সিগারেট দিয়া অন্য কথা পাড়িয়াছিল।

‘১৭২/২ বৌবাজার স্ত্রীটের কাউকে চেনো নাকি বাঁটুল?’

‘আজ্ঞে চিনি।’

‘অনাদি হালদারকে জানো?’

‘আজ্ঞে।’

‘সেও কি তোমার–মানে–খাতক নাকি?’

বাঁটুল একটু হাসিয়াছিল‌, অর্ধদগ্ধ সিগারেটটি নিভাইয়া সযত্নে পকেটে রাখিয়া একটু গম্ভীর স্বরে বলিয়াছিল‌, ‘অনাদি হালদার আগে চাঁদা দিত‌, কয়েক মাস থেকে বন্ধ করে দিয়েছে; এখন যদি ওর ভাল-মন্দ কিছু হয়। আমাদের দায়-দোষ নেই।–কিন্তু আপনারা ওকে চিনলেন কি করে? আগে থাকতে জানা শোনা আছে নাকি?’

না‌, সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে।’

বাঁটুল অতঃপর আর কৌতুহল প্রকাশ করে নাই‌, কেবল অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটি প্রবাদ-বাক্য আমাদের শুনাইয়া দিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিয়াছিল—’জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করলে ভাল হয় না কর্তা।’

কালীপূজার দিন আসিয়া পড়িল। সকাল হইতেই চারিদিকে দুমদাম শব্দ শোনা যাইতেছে। সেগুলি উৎসবের বাদ্যোদ্যম কিংবা সম্মুখ সমরের রণদামামা তাহা নিঃসংশয়ে ঠাহর করিতে না পারিয়া আমরা বাড়িতেই রহিলাম।

সন্ধ্যার পর দীপমালায় নগর শোভিত হইল। রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে বাজি পোড়ানো আরম্ভ হইল; তুবড়ি আতস বাজি ফানুস রঙমশাল‌, সঙ্গে সঙ্গে চীনে পটুক দোদমা। পথে পথে অসংখ্য মানুষ নগর পরিদর্শনে বাহির হইয়াছে; কেহ পদব্রজে‌, কেহ গাড়ি মোটরে। মাথার উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খাঁড়া ঝুলিতেছে‌, কিন্তু কে তাহা গ্রাহ্য করে! হেসে নাও দুদিন বুইতো নয়।

আমরা বাড়ির বাহির হইলাম না‌, জানোলা দিয়া উৎসব শোভা নিরীক্ষণ করিলাম। এজন্য যদি কেহ আমাদের কাপুরুষ বলিয়া বিদ্রুপ করেন। আপত্তি করিব না‌, কিন্তু বলির ছাগশিশুর ন্যায় গলায় ফুলের মালা পরিয়া নিবেধি আনন্দে নৃত্য করিতে আমাদের ঘোর আপত্তি।

রাত্রি গভীর হইতে লাগিল। মধ্য-রাত্রে কালীপূজা‌, উৎসব পুরাদমে চলিয়াছে। আমরা যদিও শক্তির উপাসক নই‌, বুদ্ধির উপাসক‌, তবু মা কালীকে অসন্তুষ্ট করিবার অভিপ্ৰায় আমাদের ছিল না। রাত্রে পলান্ন সহযোগে মহাপ্ৰসাদ ভক্ষণ করিয়া শয়ন করিলাম।

রাত্রি শেষ হইবার পূর্বেই যে প্রভাত ঘটিত ব্যাপার সাপের মত আবার মাথা তুলিবে তাহা তখনও জানিতাম না।

একেবারে ঘুম ভাঙিল। রাত্রি সাড়ে তিনটার সময়। চারিদিক নিস্তব্ধ‌, জানোলা দিয়া বেশ ঠাণ্ডা আসিতেছে। আমি পায়ের তলা হইতে চাদরটা গায়ে জুত করিয়া জড়াইয়া আর এক ঘুম দিবার ব্যবস্থা করিতেছি এমন সময় উৎকট শব্দে ঘুমের নেশা ছুটিয়া গেল।

কে দুদ্দাড় শব্দে দরজা ঠেঙাইতেছে। শয্যায় উঠিয়া বসিয়া ভাবিলাম‌, সম্মুখ সমরের সীমানা আমাদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে‌, আজ আর রক্ষা নাই। মোটা লাঠিটা ঘরের কোণে দণ্ডায়মান ছিল‌, সেটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া শয়নকক্ষ হইতে বাহির হইলাম। যদি মরিতেই হয় লড়িয়া মরিব।

ওদিকে ব্যোমকেশও লাঠি হাতে নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়াছিল। সদর দরজা মজবুত বটে। কিন্তু আর বেশিক্ষণ নয়‌, এখনই ভাঙিয়া পড়িবে। আমরা দরজার দু’পাশে লাঠি বাগাইয়া দাঁড়াইলাম।

দুদ্দাড় শব্দ ক্ষণেকের জন্য একবার থামিল‌, সেই অবকাশে একটি ব্যগ্র কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম-ও ব্যোমকেশবাবু-একবারটি দরজা খুলুন–’

আমরা বিস্ফারিত চক্ষে পরস্পরের পানে চাহিলাম। পুরুষের গলা‌, কেমন যেন চেনা-চেনা। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘কে তুমি? নাম বল।’

উত্তর হইল—’আমি–আমি কেষ্ট দাস–শীগগির দরজা খুলুন–’

কেষ্ট দাস! সহসা স্মরণ হইল না‌, তারপর মনে পড়িয়া গেল। অনাদি হালদারের বাড়ির কষ্টবাবু!

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এত রাত্রে কী চান? সঙ্গে কে আছে?’

‘সঙ্গে কেউ নেই‌, আমি একা–।’

মাত্র একটা লোক এত শব্দ করিতেছিল। সন্দেহ দূর হইল না। ব্যোমকেশ আবার প্রশ্ন করিল ‘এত রাত্রে কী দরকার?

‘অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে। দয়া করে দরজা খুলুন। আমার বড় বিপদ।’

হতভম্ব হইয়া আবার দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। অনাদি হালদার—!

ব্যোমকেশ আর দ্বিধা করিল না‌, দ্বার খুলিয়া দিল। কেষ্টবাবু টলিতে টলিতে ঘরে প্রবেশ করিলেন। কেষ্টবাবুর চেহারা আলুথালু্‌, ভেটুকি মাছের মত মুখে ব্যাকুলতা। তদুপরি মুখ দিয়া তীব্ৰ মদের গন্ধ বাহির হইতেছে। তিনি থপি করিয়া একটি চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিলেন‌, ‘অনাদিকে কেউ গুলি করে মেরেছে। সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না। আমি বাড়িতে ছিলাম না-’

0 Shares