উপসংহার

বীরেনবাবু বলিলেন‌, ‘তাহলে এখন কর্তব্য কি? তার চেহারার বর্ণনা দিয়ে ইস্তাহার জারি করা ছাড়া আর তো কোনো পথ দেখছি না।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল‌, ‘ওটা তো হাতেই আছে। কিন্তু তার আগে-যদি ট্যাক্সির নম্বরটা পাওয়া যেত—‘

ইতিমধ্যে পুঁটিরাম চা ইত্যাদি আনিয়া বীরেনবাবুর সম্মুখে রাখিতেছিল‌, ব্যোমকেশ তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘পুঁটিরাম, তোমার ইংরিজি শেখা দরকার, আজই একখানা প্যারী সরকারের ফার্স্টবুক কিনে আনবে। অজিত আজ থেকে তোমাকে ইংরেজি শেখাবে।’

অবাস্তুর কথায় বীরেনবাবু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন‌, ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও যদি ইংরিজি জানত তাহলে আজ কোনও হাঙ্গামাই হত না।’ পুটরামের দ্বারের কাছে অবস্থিতি ও ট্যাক্সি দর্শনের কথা বলিয়া ব্যোমকেশ বিমৰ্ষভাবে মাথা নাড়িল।

পুঁটিরাম মুখের সম্মুখে মুষ্টি তুলিয়া সসম্ভ্রমে একটু কাশিল—

‘আজ্ঞে—‘

‘কি?’

‘আজ্ঞে টেক্সির লম্বর আমি দেখেছি।‘

‘তা দেখেছ–কিন্তু পড়তে তো পারেনি।’

‘আজ্ঞে‌, পড়তে পেরেছি। চারের পিঠে দুটো শূন্য‌, তারপর আবার একটা চার।’

আমরা তিনজনে অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুই ইংরিজি পড়তে জনিস?

‘আজ্ঞে না।’

‘তবে?’

‘বাংলাতে লেখা ছিল বাবু্‌, সেই জন্যেই তো চোখে পড়ল।’

আমরা চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—’বুঝেছি।’ পুঁটিরামের পিঠ চাপড়াইয়া দিয়া বলিল‌, ‘বহুত আচ্ছা! পুঁটিরাম‌, আজ থেকে—তোমার মাইনে এক টাকা বাড়িয়ে দিলুম।’

পুটিরাম সহৰ্ষে এবং সলজ্জে বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, বাইরের দাওয়ায় বসেছিলুম‌, টেক্সিতে বাংলা লম্বর দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলুম। তাইতো লম্বরটা মনে আছে হুজুর।’

বীরেনবাবু বলিয়া উঠিলেন‌, ‘কিন্তু ব্যাপারটা কি? ট্যাক্সিতে বাংলা নম্বর এল কোত্থেকে?

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘বাংলা নয়–ইংরিজি নম্বরই ছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্যক্রমে সেটা বাংলা হয়ে পড়েছিল। বুঝলেন না? আসলে নম্বরটা ৮০০৮‌, পুঁটিরাম তাকে পড়েছে। ৪০০৪ Ι

‘ওঃ–’ বীরেনবাবুর চক্ষুদ্বয় ও অধরোষ্ঠ কিছুক্ষণ বর্তুলাকার হইয়া রহিল।

অবশেষে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে আর দেরি করে লাভ কি? বীরেনবাবু্‌, এ তো আপনার কাজ। নীল রংয়ের গাড়ি‌, চালক শিখ‌, নম্বর ৮০০৮–খুঁজে বার করতে বেশি কষ্ট হবে না। আপনি তাহলে বেরিয়ে পড়ুন‌, খবরটা যত শীঘ্ৰ পাওয়া যায় ততই ভাল।’

‘আমি এখনি যাচ্ছি—‘ বীরেনবাবু উঠিয়া এক চুমুকে চা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন‌, ‘সন্ধ্যের আগেই আশা করি খবর নিয়ে আসতে পারব।’

‘শুধু খবর নয়‌, একেবারে গাড়ি ড্রাইভার সব নিয়ে হাজির হবেন। ইতিমধ্যে আমি কমিশনার সাহেবকে টেলিফোন যোগে খবরটা জানিয়ে দিই। তিনি নিশ্চয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’

গমনোদ্যত বীরেনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘আসামীর নাম বা পূর্ব পরিচয় সম্বন্ধে আপনি কোনও খবর দিতে পারেন না?’

‘নির্ভুল খবর এখন দিতে পারি। কিনা জানি না‌, তবু–’ এক টুকরা কাগজে একটা নম্বর লিখিয়া তাঁহার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আলিপুর জেলে এই কয়েদীর ইতিহাস খুলে হয়তো কিছু পরিচয় পাবেন।‘

বীরেনবাবু বলিলেন‌, ‘লোকটা তাহলে দাগী?’

‘আমার তো তাই মনে হয়। কাল সকালে তার খোঁজ করে নম্বরটা বার করেছিলুম‌, কিন্তু তার জেলের ইতিহাস পড়বার ফুরসত হয়নি। আপনি সরকারী লোক‌, এ কাজটা সহজেই পারবেন–অফিসের মারফত। কেমন?’

‘নিশ্চয়।’

বীরেনবাবু কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করিয়া পকেটে রাখিয়া প্রস্থান করিলেন।

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে দু’জনে বীরেনবাবুর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। ব্যোমকেশ তাহার রিভলবারটা তেল ও ন্যাকড়া দিয়া পরিষ্কার করিতেছিল।

আমি বলিলাম‌, ‘বীরেনবাবু তো এখনো এলেন না।’

‘এইবার আসবেন। ‘ ব্যোমকেশ একবার ঘড়ির দিকে চোখ তুলিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আচ্ছ ব্যোমকেশ‌, লোকটার আসল নাম কি? তুমি নিশ্চয় জানো?’

‘আমি তো বলেছি‌, এখনও ঠিক জানি না।’

‘তবু আন্দাজ তো করেছ।’

‘তা করেছি।’

‘কে লোকটা? আমার চেনা নিশ্চয়–না?’

‘শুধু চেনা নয়‌, তোমার একজন পুরনো বন্ধু।’

‘কি রকম?’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘সেই চিঠিখানাতে কোকনন্দ গুপ্ত নাম ছিল মনে আছে বোধ হয়। তা থেকে কিছু অনুমান করতে পার না?’

‘কি অনুমান করব। কোকনন্দ গুপ্ত তো ছদ্মনাম।’

‘সেই জন্যই তো তাতে আরো বেশি করে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। মানুষের সত্যিকার নামকরণ হয় সম্পূর্ণ খেয়ালের বশে‌, অধিকাংশ স্থলেই কানা ছেলের নাম হয় পদ্মলোচন। যেমন তোমার নাম অজিত‌, আমার নাম ব্যোমকেশ–আমাদের বর্ণনা হিসাবে নাম–দুটোর কোনও সার্থকতা নেই। কিন্তু মানুষ যখন ভেবে চিস্তে ছদ্মনাম গ্ৰহণ করে তখন তার মধ্যে অনেকখানি ইঙ্গিত পুরে দেবার চেষ্টা করে। কোকনন্দ শব্দটা তোমাকে কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে না? কোনও একটা শব্দগত সাদৃশ্য?’

আমি ভাবিয়া বলিলাম‌, ‘কি জানি‌, আমি তো এক কোকোন ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই সাদৃশ্য পাচ্ছি না।’

ব্যোমকেশ হাসিল, ‘বলিল, ‘কোকনদের সঙ্গে কোকেনের সাদৃশ্য মোটেই কাব্যানুমোদিত নয়, তাই তোমার মন উঠছে না–কেমন? কিন্তু–ঐ বীরেনবাবু আসছেন‌, সঙ্গে আর একজন। অজিত‌, আলোটা জ্বেলে দাও‌, অন্ধকার হয়ে গেছে।’

বীরেনবাবু প্ৰবেশ করিলেন; তাঁহার সঙ্গে একটি দীর্ঘাকৃতি শিখ। শিখের মুখে প্রচুর গোঁফ-দাড়ি-গ্রন্থি বাঁধিয়া তাহাদের উচ্ছঙ্খলতা কিঞ্চিৎ সংযত করা হইয়াছে। মাথায় বেণী।

0 Shares