উপসংহার

ব্যোমকেশ উভয়কে আদর করিয়া বসাইল।

কালব্যয় না করিয়া ব্যোমকেশ শিখকে প্রশ্ন আরম্ভ করিল। শিখ বলিল‌, আজ সকালের আরোহীকে তাহার বেশ মনে আছে। তিনি বেলা আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় তাহার ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া শ্রীরামপুরে যান; সেখানে হাসপাতালের অনতিদূতে গাড়ি রাখিয়া তিনি হাসপাতালে প্রবেশ করেন। অল্পক্ষণ পরেই আবার লৌটিয়া আসিয়া দ্রুত কলিকাতায় ফিরিয়ে আসিতে আদেশ করেন। কলিকাতায় পহুঁছিয়া তিনি এই বাসায় নামেন‌, তারপর সামান্য কিছু সামান্‌ লইয়া আবার গাড়িতে আরোহণ করেন। এখান হইতে বউবাজারের কাছাকাছি একটা স্থানে গিয়া তিনি শেষবার নামিয়া যান। তিনি ভাড়া চুকাইয়া দিয়া উপরন্তু দুই টাকা বখশিশ দিয়াছেন; ইহা হইতে শিখের ধারণা জন্মিয়াছে সে লোকটি অতিশয় সাধু ব্যক্তি।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘তিনি শেষবার নেমে গিয়ে কি করলেন?’

শিখ বলিল‌, তাহার যতদূর মনে পড়ে তিনি একজন ঝাঁকামুটের মাথায় তাঁহার বেগ্‌ ও জলের সোরাহি চড়াইয়া দিয়া প্ৰস্থান করিয়াছিলেন; কোনদিকে গিয়াছিলেন তাহা সে লক্ষ্য করে নাই।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুমি তোমার গাড়ি এনেছ। সেই বাবুটকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলে আমাদের ঠিক সেইখানে পৌঁছে দিতে পারবে?’

শিখ জানাইল যে বে-শক্‌ পারিবে।

তখন আমরা দুইজনে তাড়াতাড়ি তৈয়ার হইয়া নীচে নামিলাম। নীল রংয়ের গাড়ি বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিল‌, ৮০০৮ নম্বর গাড়িই বটে। আমরা তিনজনে তাহাতে উঠিয়া বসিলাম। শিখ গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল।

রাত্রি হইয়াছিল। গাড়ির অন্ধকারের মধ্যে বসিয়া বীরেনবাবু হঠাৎ বলিলেন‌, ‘আপনার কয়েদীর খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। ইনি তিনিই বটে। মাস ছয়েক হল জেল থেকে বেরিয়েছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাক‌, তাহলে আর সন্দেহ নেই। মুখ পুড়েছিল কি করে?’

‘ইনি শিক্ষিত ভদ্রলোক আর বিজ্ঞানবিৎ বলে এঁকে জেল-হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল। বছর দুই আগে একটা নাইট্রিক অ্যাসিডের শিশি ভেঙে গিয়ে মুখের ওপর পড়ে। বাঁচবার আশা ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলেন।’

আর কোনও কথা হইল না। মিনিট পনেরো পরে আমাদের গাড়ি এমন একটা পাড়ায় গিয়া দাঁড়াইল যে আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, এ কি! এ যে আমাদের–’। বহুদিনের পুরাতন কথা মনে পড়িয়া গেল। এই পাড়ারই একটা মেসে ব্যোমকেশের সহিত আমার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল।*(‘সত্যান্বেষী’ গল্প দ্রষ্টব্য।)

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল।‘ চালককে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এইখানেই তিনি গিয়েছিলেন?’

চালক বলিল‌, ‘হাঁ।’

একটু চিন্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, এবার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে চল।’ বীরেনবাবু বলিয়া উঠিলেন‌, ‘সে কি‌, নামবেন না?’

‘দরকার নেই। আমাদের শিকার কোথায় আছে আমি জানি।’

‘তাহলে তাকে এখনি গ্রেপ্তার করা দরকার।’

ব্যোমকেশ বীরেনবাবুর দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে? দেশলায়ের বাক্সটা চাই না?’

‘না না–তা চাই বৈ কি। তাহলে কি করতে চান?’

‘আগে দেশলায়ের বাক্সটা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর তাকে ধরতে চাই। চলুন‌, কি করতে হবে বাসায় গিয়ে বলব।’

আমরা আবার ফিরিয়া চলিলাম।

রাত্রি আটটার সময় আমি‌, ব্যোমকেশ ও বীরেনবাবু একটা অন্ধকার গলির মোড়ে এক ভাড়াটে গাড়ির মধ্যে লুকাইয়া বসিলাম। এইখানে একটা গাড়ির স্ট্যান্ড আছে—তাই‌, আমাদের গাড়িটা কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না।

সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে আমাদের সেই পুরাতন মেস। বাড়িখানা এ কয় বৎসরে কিছুমাত্র বদলায় নাই‌, যেমন ছিল তেমনই আছে। কেবল দ্বিতলের মেসটা উঠিয়া গিয়াছে; উপরের সারি সারি জানালাগুলিতে কোথাও আলো নাই।

মিনিট কুড়ি-পঁচিশ অপেক্ষা করিবার পর আমি বলিলাম‌, আমরা ধরনা দিচ্ছি‌, কিন্তু উনি যদি আজ রাত্রে না বেরোন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেরুবেন বৈ কি। রাত্রে আহার করতে হবে তো।’

আরো কুড়ি মিনিট কাটিয়া গেল। ব্যোমকেশ গাড়ির খড়খড়ির ভিতর চক্ষু নিবদ্ধ করিয়াছিল‌, সহসা চাপা গলায় বলিল‌, ‘এইবার! বেরুচ্ছেন তিনি।’

আমরাও খড়খড়িতে চোখ লোগাইয়া দেখিলাম‌, একজন লোক আপাদমস্তক র‍্যাপার মুড়ি দিয়া সেই বাড়ির দরজা হইতে বাহির হইয়া আসিল‌, তারপর একবার ক্ষিপ্ত-দৃষ্টিতে রাস্তার দুইদিকে তাকাইয়া দ্রুতপদে দূরের অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।

রাস্তায় লোক চলাচল ছিল না বলিলেই হয়। সে অদৃশ্য হইয়া গেলে আমরা গাড়ি হইতে নামিয়া বাড়ির সম্মুখীন হইলাম।

সম্মুখের দরজায় তালা বন্ধ। ব্যোমকেশ মৃদু স্বরে বলিল‌, ‘এদিকে এস।’

পাশের যে-দরজা দিয়া উপরে উঠিবার সিঁড়ি আরম্ভ হইয়াছে‌, সে দরজাটা খোলা ছিল; আমরা তাহার ভিতরে প্রবেশ করিলাম। এইখানে সরু একফালি বারান্দা, তাহাতে একটি দরজা নীচের ঘরগুলিকে উপরের সিঁড়ির সহিত সংযুক্ত করিয়াছে। ব্যোমকেশ পকেট হইতে একটা টর্চ বাহির করিয়া দরজাটা দেখিল; বহুকাল অব্যবহৃত থাকায় দরজা কীটদষ্ট ও কমজোর হইয়া পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ জোরে চাপ দিতেই হুড়কা ভাঙিয়া দ্বার খুলিয়া গেল। আমরা ঘরে প্ৰবেশ করিলাম।

ভাঙা দরজা স্বাভাবিক রূপে ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ টর্চের আলো চারিদিকে ফিরাইল। ঘরটা দীর্ঘকাল অব্যবহৃত‌, মেঝোয় পুরু হইয়া ধূলা পড়িয়াছে‌, কোণে ঝুল ও মাকড়সার জাল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা নয়‌, ওদিকে চল।’

0 Shares