ঘরের একটা দ্বার ভিতরের দিকে গিয়াছিল, সেটা দিয়া আমরা অন্য একটা ঘরে উপস্থিত হইলাম। এ ঘরটা আমাদের পরিচিত, বহুবার। এখানে বসিয়া আড্ডা দিয়াছি। টর্চের আলোয় দেখিলাম ঘরটি সম্প্রতি পরিষ্কৃত হইয়াছে, একপাশে একটি তক্তপোশের উপর বিছানা পাতা, মধ্যস্থলে একটি টেবিল ও চেয়ার। ব্যোমকেশ ঘরটার চারিপাশে আলো ফেলিয়া দেখিয়া লইয়া বলিল, ‘হুঁ, এই ঘরটা। বীরেনবাবু্, এবার আসুন অন্ধকারে বসে গৃহস্বামীর প্রতীক্ষা করা যাক।’
বীরেনবাবু ফিসফিস করিয়া বলিলেন, ‘দেশলায়ের বাক্সটা এই বেলা—’
‘সেজন্যে ভাবনা নেই। রিভলবার আর হাতকড়া পকেটে আছে তো?’
‘আছে।’
‘বেশ। মনে রাখবেন, লোকটি খুব শান্ত-শিষ্ট নয়।’ আমি এবং বীরেনবাবু তক্তপোশের উপর বসিলাম, ব্যোমকেশ চেয়ারটা দখল করিল। অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে প্ৰতীক্ষা আরম্ভ হইল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। আধঘণ্টা তখনও অতীত হয় নাই, বাহিরের দরজায় খুট্ করিয়া শব্দ হইল। আমরা খাড়া হইয়া বসিলাম; নিশ্বাস আপনা হইতে বন্ধ হইয়া গেল।
অতি মৃদু পদক্ষেপ অন্ধকারে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। তারপর সহসা ঘরের আলো দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সহজ স্বরে বলিল, ‘আসতে আজ্ঞা হোক অনুকুলবাবু। আমরা আপনার পুরনো বন্ধু, তাই অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছি। কিছু মনে করবেন না।’
অনুকুল ডাক্তার–অর্থাৎ দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু–সুইচে হাত দিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। কিছুক্ষণ তিনি কথা কহিলেন না। তাঁহার পক্ষ্মহীন চক্ষু দুটি একে একে আমাদের তিনজনকে পরিদর্শন করিল। তারপর তাঁহার বিবৰ্ণ বিকৃত মুখে একটা ভয়ঙ্কর হাসি দেখা দিল; তিনি দাঁতের ভিতর হইতে বলিলেন, ‘ব্যেমকেশবাবু যে! সঙ্গে পুলিস দেখছি। কি চাই? কোকেন?’
ব্যেমকেশ মাথা নাড়িয়া হাসিল–’না না, অত দামী জিনিস চেয়ে আপনাকে বিপদগ্ৰস্ত করব না। আমরা অতি সামান্য জিনিস চাই–একটা দেশলায়ের বাক্স।’
অনুকুলবাবুর অনাবৃত চক্ষু দুটা ব্যোমকেশের মুখের উপর স্থির হইয়া রহিল। তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘দেশলায়ের বাক্স। তার মানে?’
‘মানে, যে-বাক্স থেকে একটি কাঠি সম্প্রতি ট্রামে যেতে যেতে আপনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন, তার বাকি কাঠিগুলি আমার চাই। আপনি তাদের যে মূল্য ধাৰ্য করেছেন অত টাকা তো আমি দিতে পারব না, তবে আশা আছে বন্ধুজ্ঞানে সেগুলি আপনি বিনামূল্যেই আমায় দেবেন।’
‘আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘পারছেন বৈকি। কিন্তু হাতটা আপনি সুইচ থেকে সরিয়ে নিন। ঘর হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে আমাদের চেয়ে আপনারই বিপদ হবে বেশি। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেননি, দুটি রিভলবার আপনার বুকের দিকে স্থির লক্ষ্য করে আছে।’
অনুকুলবাবু সুইচ ছাড়িয়া দিলেন। তাঁহার মুখে পাশবিক ক্ৰোধ এতক্ষণে উলঙ্গ মূর্তি ধরিয়া দেখা দিল। তিনি চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘(ছাপিবার যোগ্য নয়) আমার জীবনটা তুই নষ্ট করে দিয়েছিস! তো…’ অনুকুলবাবুর ঠোঁটের কোণে ফেনা গাঁজাইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘ডাক্তার, জেলখানায় থেকে তোমার ভাষাটা বড় ইয়ে হয়ে গেছে দেখছি। দেবে না তাহলে দেশলায়ের বাক্সটা?’
‘না—দেব না। আমি জানি না কোথায় দেশলায়ের বাক্স আছে। তোর সাধ্য হয় খুঁজে নে,–কোথাকার।’
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল–’খুঁজেই নিই তাহলে।—বীরেনবাবু্, আপনি সতর্ক থাকবেন।’
ব্যোমকেশ তক্তপোশের শিয়রে গিয়া দাঁড়াইল। গেলাস-ঢাকা জলের কুঁজোটা সেখানে রাখা ছিল, সেটা দুহাতে তুলিয়া লইয়া সে মেঝের উপর আছাড় মারিল। কুঁজা সশব্দে ভাঙিয়া গিয়া চারিদিকে জলস্রোত প্ৰবাহিত হইয়া গেল।
কুঁজার ভগ্নাংশগুলি মধ্য হইতে নীল কাপড়ে মোড়া শিশির মত একটা জিনিস তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ আলোর সম্মুখে আসিয়া পরীক্ষা করিল, বলিল, ‘ওয়াটারপ্রুফ, শিশি, সীলমোহর, সব ঠিক আছে–শিশিটা ভাঙেনি দেখছি—বীরেনবাবু্, দেশলাই পাওয়া গেছে—এবার চোরকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।’
৬
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘এই কাহিনীর মরাল হচ্ছে-ভাগ্যং ফলতি সর্বত্ৰ ন বিদ্যা ন চ পৌরুষং। পুঁটিরাম যদি দাওয়ায় বসে না থাকত এবং ট্যাক্সির নম্বরটা ৮০০৮ না হত, তাহলে আমরা অনুকুলবাবুকে পেতুম কোথায়?’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তা তো বুঝলুম, কিন্তু দেশলাই-চোর যে অনুকুলবাবু এ সন্দেহ তোমার কি করে হল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার সত্যান্বেষী জীবনে যতগুলি ভয়ঙ্কর শত্ৰু তৈরি করেছি, তার মধ্যে কেবল তিনজন বেঁচে আছে। প্রথম–পেশোয়ারী আমীর খাঁ, যে মেয়ে-চুরির ব্যবসাকে সূক্ষ্ম ললিতকলায় পরিণত করেছিল। বিচারে পিনাল কোডের কয়েক ধারায় তার বারো বছর জেল হয়। দ্বিতীয়–পলিটিক্যাল দালাল কুঞ্জলাল সরকার, যে সরকারী অর্থনৈতিক গুপ্ত সংবাদ চুরি করে শেয়ার মার্কেটে বিক্রি করত। বছর দুই আগে তার সাত বছর শ্ৰীঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। তৃতীয়—আমাদের অনুকুল ডাক্তার। ইনি কোকেনের ব্যবসা এবং আমাকে খুন করবার চেষ্টার অপরাধে দশ বছর জেলে যান। হিসেব করে দেখছি, বর্তমানে কেবল অনুকুলবাবুরই জেল থেকে বেরুবার সময় হয়েছে। সুতরাং অনুকুলবাবু ছাড়া আর কে হতে পারে?’
‘তা বটে। কিন্তু এই দগ্ধানন ভদ্রলোকটিই যে অনুকুলবাবু এ সন্দেহ তোমার হয়েছিল?’