‘আমার মনে হয়-আমার সন্দেহ হয়–‘
এই সময় সিঁড়িতে বীরেনবাবুর ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল, ব্যোমকেশ কথাটা শেষ করিল না।
বীরেনবাবু আসিয়া গভীর মুখে উপবেশন করিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে সিগারেট দিয়া বলিল, ‘নিজের দেশলাই দিয়ে ধরান। দেবকুমারবাবুর দেশলায়ের বাক্স কবে চুরি গেল?’
‘পরশু’–বলিয়াই বীরেনবাবু বিস্ফারিত নেত্ৰে চাহিলেন–’আপনি জানলেন কোত্থেকে? একথা তো চাপা আছে, বাইরে বেরুতে দেওয়া হয়নি।’
‘স্বয়ং চোর আমাকে খবর পাঠিয়েছে’–বলিয়া ব্যোমকেশ ট্রামে দেশলাই বদলের ব্যাপারটা বিবৃত করিল।
বীরেনবাবু গভীর মনোযোগ দিয়া শুনিলেন, তারপর দেশলায়ের বাক্সটা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া সন্তৰ্পণে সরাইয়া রাখিয়া বলিলেন, ‘এর মধ্যে একটা মারাত্মক কাঠি আছে–বাপ! লোকটা কে আপনার কিছু সন্দেহ হয় না?’
‘না। তবে যেই হোক, আমাকে যে মারতে চায়, তাতে সন্দেহ নেই।’
‘কিন্তু কেন? এত লোক থাকতে আপনাকেই বা মারতে চাইবে কেন?’
আমি বলিলাম, ‘হয়তো সে মনে করে ব্যোমকেশকে মারতে পারলে তাকে ধরা কঠিন হবে তাই আগেভাগেই ব্যোমকেশকে সরাতে চায়।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—’আমার তা মনে হয় না। পুলিসের অসংখ্য কর্মচারী রয়েছেন যাঁরা বুদ্ধিতে কর্মদক্ষতায় আমার চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। বীরেনবাবুর কথাই ধর না। চোরের যদি সেই উদ্দেশ্যই থাকতে তাহলে সে আমাকে না মেরে বীরেনবাবুকে মারবার চেষ্টা করত।’
প্ৰশংসাটা কিছু মারাত্মক জাতীয় হইলেও দেখিলাম বীরেনবাবু মনে মনে খুশি হইয়াছেন। তিনি বলিলেন, ‘না-না—তবে-অন্য কি কারণ থাকতে পারে?’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘সেইটেই ঠিক ধরতে পারছি না। যতদূর মনে পড়ছে আমার ব্যক্তিগত শত্ৰু কেউ নেই।’
বীরেনবাবু ঈষৎ বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, ‘বলেন কি মশায়! আপনি এতদিন ধরে চোর-ছাঁচড় বদমায়েসের পিছনে লেগে আছেন, আর আপনার শত্ৰু নেই! আমাদের পেশাই তো শত্ৰু তৈরি করা।’
এই সময় পুঁটিরাম চা লইয়া আসিল। একটা পেয়ালা বীরেনবাবুর দিকে আগাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ মৃদুহাস্যে বলিল, ‘তা বটে। কিন্তু আমার অধিকাংশ শত্ৰুই বেঁচে নেই। যা হোক, এবার বলুন তো কি করে জিনিসটা চুরি গেল?’
বীরেনবাবু চায়ে এক চুমুক দিয়া বলিলেন, ‘ঠিক কি করে চুরি গেল তা বলা কঠিন। আপনি তো জানেন দেশলায়ের বাক্সটা দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমায় একজিবিট ছিল, কাজেই সেটা পুলিসের তত্ত্বাবধান থেকে কোর্টের এলাকায় গিয়ে পড়েছিল। পরশু মোকদ্দমা শেষ হয়েছে, তারপর থেকে আর সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি! সন্দেহের ওপর কয়েকজন আদলি আর নিম্নাতন কর্মচারীকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, আর কিছু হচ্ছে না। এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে মহা হৈচৈ পড়ে গেছে, খোদ গভর্নমেন্টের পর্যন্ত টনক নড়েছে। এখন আপনি একমাত্র ভরসা!’
‘আমাকে কি করতে হবে?’
‘খাস ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট থেকে হুকুম এসেছে, চোর ধরা পড়ুক বা না পডুক, দেশলায়ের বাক্স উদ্ধার করা চাই। এর ওপর নাকি আন্তজাতিক শান্তি নির্ভর করছে।’
‘বুঝলুম। কিন্তু আমাকে যে আপনি এ কাজে ডাকছেন–এতে কর্তৃপক্ষের মত আছে কি?’
‘আছে। আপনাকে তাহলে সব কথা বলি। দেশলায়ের বাক্স লোপাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেসটা সি আই ডি পুলিসের হাতে যায়। কিন্তু আজ তিন দিন ধরে অনুসন্ধান করেও তারা কোনও হদিস বার করতে পারেনি। এদিকে প্রত্যহ তিন-চার বার গভর্নমেন্টের কড়া তাগাদ আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত বড়সাহেব আপনার সাহায্য তলব করেছেন। তাঁর বিশ্বাস এ ব্যাপারে সমাধান যদি কেউ করতে পারে তো সে আপনি।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া একবার ঘরময় পায়চারি করিল, তারপর বলিল, ‘তাহলে আর কোনও কথা নেই। কিন্তু–আমি একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘আপনি যখন যাবেন তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।’
‘বেশ–একটু চিস্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ আর নয়, কাল তাঁর সঙ্গে দেখা করব। আজকের দিনটা আমাকে ভাবতে দিতে হবে।’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘কিন্তু যতই দেরি হবে–‘
‘সে আমি বুঝেছি, কিন্তু তাড়াতাড়ি যাহোক একটা কিছু করলেই তো হবে না। একটা অজানা লোককে ধরতে হবে, অথচ এমন সূত্র কোথাও নেই। যা ধরে তার কাছে পৌঁছুঁতে পারা যায়। একটু বিবেচনা করে পন্থা স্থির করতে হবে না?’
‘তা বটে—‘
‘ইতিমধ্যে যে লোকগুলিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে যদি কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেন তার চেষ্টা করুন। যদি–’
বীরেনবাবু গম্ভীর মুখে একটু হাসিলেন–‘তিন দিন ধরে অনবরত সে চেষ্টা হচ্ছে, কোনো ফল হয়নি। আপনি যদি চেষ্টা করে দেখতে চান, দেখতে পারেন।’
‘পারব মনে হয় না। তারা হয়তো নির্দোষ। যাক, তাহলে ঐ কথা রইল, কাল আমি সাহেবের সঙ্গে দেখা করব; তারপর যাহোক একটা কিছু করা যাবে। এ ব্যাপারে আমার নিজের যথেষ্ট স্বাৰ্থ রয়েছে, কারণ চোর মহাশয় প্রথমে আমার ওপরেই কৃপা-দৃষ্টিপাত করেছেন।’
অতঃপর আরো কিছুক্ষণ বসিয়া বীরেনবাবু গাত্ৰোত্থান করিলেন। তিনি প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া দেশলায়ের বাক্সটা নিজের লাইব্রেরি। ঘরে রাখিয়া আসিল। তারপর পিছনে হাত রাখিয়া গভীর ভ্রূকুঞ্চিত মুখে ঘরে পায়চারি করিতে লাগিল।
এগারোটা বাজিয়া গেলে পুঁটিরাম আসিয়া স্নানের তাগাদ দিয়া গেল, কিন্তু তাহার কথা ব্যোমকেশের কানে পৌঁছিল না। সে অন্যমনস্কভাবে একটা ‘হুঁ’ দিয়া পূর্ববৎ ঘরময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।