এই সময় ডাকপিওন আসিল। একখানা খাম ব্যোমকেশের হাতে দিয়া বলিল, ‘দেখুন তো এটা আপনার চিঠি কিনা।’
ব্যোমকেশ খামের শিরোনামা দেখিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, আমারই। কেন বল দেখি?’
পিওন কহিল, ‘নীচের মেসে এক ভদ্রলোক বলছিলেন এটা তাঁর চিঠি।’
‘সে কি! ব্যেমকেশ বক্সী আরো আছে নাকি?’
‘তিনি বললেন, তাঁর নাম ব্যোমকেশ বোস।’
ব্যোমকেশ চিঠিখানা আরো ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, ‘ও–তা হতেও পারে বাগবাজারের মোহর দেখছি।–কলকাতা থেকেই চিঠি আসছে। কিন্তু আমাকে কলকাতা থেকে খামে চিঠি কে লিখবে? যা হোক, খুলে দেখলেই বোঝা যাবে। যদি আমার না হয়—কিন্তু নীচের মেসে ব্যোমকেশ নামে আর একজন আছেন এ খবর তো জানতুম না।’
পিওন প্রস্থান করিল। ব্যোমকেশ কাগজ-কাটা ছুরি দিয়া খাম কাটিয়া চিঠি বাহির করিল, তাহার উপর চোখ বুলাইয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘আমার নয়। কোকনদ গুপ্ত–অদ্ভুত নাম—কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না।’
চিঠিতে লেখা ছিল–
সম্মান পুরঃসর নিবেদন,
ব্যোমকেশবাবু্, অনেকদিন আপনার সহিত দেখা হয় নাই, কিন্তু তবু আপনার কথা ভুলিতে পারি নাই। আবার সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ হইয়া আছি। চিনিতে পারিকেন তো? কি জানি, অনেকদিন পরে দেখা, হয়তো অধমকে না চিনিতেও পারেন।
আপনার কাছে আমি অশেষভাবে ঋণী, আপনার কাছে আমার জীবন বিক্রীত হইয়া আছে। কিন্তু কর্মের জন্য বহুকাল স্থানান্তরে ছিলাম বলিয়া সে-ঋণের কণামাত্র পরিশোধ করিতে পারি নাই। এখন ফিরিয়া আসিয়াছি, সাধ্যমত চেষ্টা করিব।
আমার কৃতজ্ঞতাপূর্ণ প্রীতিনমস্কার গ্রহণ করিকেন।
ইতি
আপনার গুণমুগ্ধ
শ্ৰীকোকনন্দ গুপ্ত
চিঠিখানা পড়িয়া আমি বলিলাম, ‘এ চিঠি আমাদের পড়া উচিত হয়নি। অবশ্য গোপনীয় কিছু নেই, তবু এমন আন্তরিক কথা আছে যা অন্যের পড়া অপরাধ।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা তো বুঝছি। প্রেমিক প্রেমিকার চিঠি চুরি করে পড়ার মত এ চিঠিখানা পড়লেও মনটা লজ্জিত হয়ে ওঠে। কিন্তু উপায় কি বল। চিঠি আমার কিনা যাচাই করা চাই তো। কোকনন্দ গুপ্ত বলে কাউকে আমি চিনি না, আর চিনলেও তার কোনও মহৎ উপকার করেছি বলে স্মরণ হচ্ছে না।’
‘তাহলে যার চিঠি তাকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘হাঁ। পুঁটিরামকে ডাকি।’
কিন্তু পুঁটিরাম আসিবার পূর্বেই চিঠির মালিক নিজে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নীচের মেসের সকল অধিবাসীর সঙ্গেই আমাদের মুখ চেনাচিনি ছিল, ইহাকে কিন্তু পূর্বে দেখি নাই। লোকটি বেঁটে-খাটো দোহারা, বোধ করি মধ্যবয়স্ক–কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া বয়স অনুমান করিবার উপায় নাই। কপাল হইতে গলা পর্যন্ত মুখখানা পুড়িয়া, চামড়া কুঁচকাইয়া এমন একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করিয়াছে যে পূর্বে তাঁহার চেহারা কিরূপ ছিল তাহা অনুমান করাও অসম্ভব। হঠাৎ মনে হয় যেন তিনি একটা বিকট মুখোশ পরিয়া আছেন। মুখে গোঁফ দাড়ি নাই, এমন কি চোখের পল্লব পর্যন্ত চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চোখের দৃষ্টিতে মৎস্যচক্ষুর ন্যায় অনাবৃত নিষ্পলক ভাব দেখিয়া সহসা চমকিয়া উঠিতে হয়।
ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করিয়াই আমাদের চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দিয়াছিলেন, তাই তাঁহার সহজ সাধারণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া যেন রূপকথার রাজ্য হইতে ফিরিয়া আসিলাম। তিনি দ্বারের নিকট হইতে ঈষৎ কুষ্ঠিত স্বরে বলিলেন, ‘আমার নাম ব্যোমকেশ বসু। একখানা চিঠি—‘
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, ‘আসুন। চিঠিখানা আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলুম। আপনি এসেছেন–ভালই হল। বসুন। কিছু মনে করবেন না, নিজের মনে করে খাম খুলেছিলুম। এই নিন।’
পত্রটা হাতে লইয়া ভদ্রলোক ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘কোকনন্দ গুপ্ত! কৈ আমার তো–’ ব্যোমকেশের দিকে চোখ তুলিয়া বলিলেন, ‘আপনার চিঠি নয়? আপনি পড়েছেন নিশ্চয়।’
অপ্ৰস্তুতভাবে ব্যোমকেশ বলিল, ‘পড়েছি, নিজের মনে করে—কিন্তু পড়ে দেখলুম আমার নয়। পিওন বলেছিল বটে। কিন্তু খামের ওপর ‘বোস’ কথাটা এমনভাবে লেখা হয়েছে যে বক্সী বলে ভুল হয়। জানেন বোধহয়, আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী?’
‘জানি বৈকি। আপনি এ মেসের গৌরব; এখানে এসেই আপনার নাম শুনেছি। কিন্তু চিঠিটা আমার কি না ঠিক বুঝতে পারছি না। কোকনদ গুপ্ত নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে বটে, তবু–, যা হোক, আপনি যখন বলছেন আপনার নয়। তখন আমারই হবে।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘মহৎ লোকের পক্ষে উপকার করে ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক।’
‘না না, তা নয়—অনেক দিনের কথা, তাই হঠাৎ মনে পড়ছে না। পরে হয়তো পড়বে।—আচ্ছা, নমস্কার।’ বলিয়া তিনি প্ৰস্থানোদ্যত হইলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি এ মেসে কত দিন এসেছেন?’
‘বেশি দিন নয়। এই তো দিন পাঁচ-সাত।’
‘ও’-ব্যোমকেশ হাসিল, ‘যা হোক, তবু এতদিনে একজন মিতে পাওয়া গেল। আচ্ছা, নমস্কার। সময় পেলে মাঝে মাঝে আসবেন, গল্প-সল্প করা যাবে।’
ভদ্রলোক আনন্দিতভাবে সম্মতি জানাইয়া প্ৰস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ একবার ঘড়ির দিকে তাকাইয়া জামার বোতাম খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘অনেক বেলা হয়ে গেল, চল নেয়ে খেয়ে নেওয়া যাক; তারপর দেশলাই চুরির মামলা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবা যাবে। অনেক ভাববার কথা আছে; যে-বনে শিকার নেই সেই বন থেকে বাঘ মেরে আনতে হবে। আচ্ছা, আমাদের এই দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুটকে আগে কোথাও দেখেছ বলে বোধ হচ্ছে কি?’
আমি দৃঢ়স্বরে বলিলাম, ‘না, ও-মুখ কদাচ দেখিনি। তুমি দেখেছি নাকি?’