দ্রুত জুতা জামা পরিয়া ব্যোমকেশের সহিত বাহির হইলাম।
‘কালকেতু’ অফিসে গিয়া কাযাধ্যক্ষ মহাশয়ের সাক্ষাৎ পাইতে বিলম্ব হইল না। ব্যোমকেশের প্রশ্ন শুনিয়া তিনি বলিলেন, ‘বিজ্ঞাপন বিভাগ আমার খাস এলাকায় নয়, তবু এ বিজ্ঞাপনটা সম্বন্ধে আমি জানি। ইন্সিওর-করা খামখানা আমার হাতেই এসেছিল। মনেও আছে, তার কারণ এমন আশ্চর্য বিজ্ঞাপন আমরা কখনও পাইনি।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা লোকটিকে আপনি দেখেননি?’
‘না। বললুম তো, ডাকে বিজ্ঞাপনটা এসেছিল। খামের মধ্যে কুড়ি টাকার নোট আর বিজ্ঞাপনের খসড়া ছিল। প্রেরকের নাম ছিল না। খুবই আশ্চর্য হয়েছিলুম; কিন্তু তখন আমাদের কাজের সময়, তাই বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজারকে ডেকে খসড়া তাঁর জিম্মা করে দিই, তারপর ভুলে গিয়েছি। ব্যাপার কি বলুন তো? দেশলায়ের বাক্স দেখে সন্দেহ হচ্ছে, গুরুতর কিছু নাকি?’
ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল, ‘আপনাদের কানে পৌঁছুবার মত এখনও কিছু হয়নি। আচ্ছা, প্রেরক সম্বন্ধে কোনও খবরই দিতে পারেন না? তার ঠিকনা?’
কার্যাধ্যক্ষ মাথা নাড়িলেন, ‘খামের মধ্যে নোট আর বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু ছিল না।’
‘ইন্সিওর-করা খামে বিজ্ঞাপন এসেছিল বলছেন। খামের ওপরেও প্রেরকের নাম ঠিকানা ছিল না?’
কার্যাধ্যক্ষ সচকিতভাবে বলিলেন, ‘ওটা তো খেয়াল করিনি। নিশ্চয় ছিল। অন্তত থাকা উচিত। যতদূর জানি প্রেরকের নাম-ঠিকানা না থাকলে পোস্ট-অফিসে রেজিস্ট্রি চিঠি নেয় না—‘
টেবিলের পাশে একটা প্ৰকাণ্ড ওয়েস্ট-পেপার-বাস্কেট ছিল, অধ্যক্ষ মহাশয় হঠাৎ উঠিয়া তাহার মধ্যে হাতড়াইতে আরম্ভ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে বিজয়গর্বে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘পেয়েছি–এই, এই নিন।’
সাধারণ সরকারী রেজিস্ট্রি খাম, তাহার কোণে প্রেরকের নাম ও ঠিকানা রহিয়াছে–
বি কে সিংহ
১৮/১, সীতারাম ঘোষের স্ট্রীট, কলিকাতা
ঠিকনা টুকিয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাদের পাড়াতেই দেখছি। —এখন তাহলে উঠলুম, অকারণে বসে থেকে আপনার কাজের ক্ষতি করব না–বহু ধন্যবাদ৷’
অধ্যক্ষ বলিলেন, ‘ধন্যবাদের দরকার নেই; যদি নতুন খবর কিছু থাকে, আগে যেন পাই। জানেন তো, দেবকুমারবাবুর কেস আমরাই আগে ছেপেছিলুম।’
‘আচ্ছা, তাই হবে’ বলিয়া আমরা বিদায় লইলাম।
কালকেতু অফিস হইতে আমরা সোজা সীতারাম ঘোষের স্ত্রীটে ফিরিলাম। ১৮/১ নম্বর বাড়িখানা দ্বিতল ও ক্ষুদ্র, রেলিং-এর উপর লেপ তোষক শুকাইতেছে, ভিতর হইতে কয়েকটি ছেলেমেয়ের পড়ার গুঞ্জন আসিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভুল ঠিকানা। যা হোক, যখন এসেছি তখন খোঁজ নিয়ে যাওয়া যাক।’
ডাকাডাকি করিতে একজন চাকর বাহির হইয়া আসিল–‘কাকে চান বাবু?’
‘বাবু বাড়ি আছেন?’
‘না।‘
‘এ বাড়িতে কে থাকে?’
‘দারোগাবাবু থাকেন।’
‘দারোগাবাবু? নাম কি?’
‘বীরেনবাবু!’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাকরিটার মুখের পানে হ্যাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ হাসিয়া উঠিয়া বলিল, ‘ও–বুঝেছি। তোমার বাবু বাড়ি এলে বোলো ব্যোমকেশবাবু দেখা করতে এসেছিলেন।‘ বলিয়া হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া চলিল।
আমি বলিলাম, ‘তুমি বড় খুশি হয়েছ দেখছি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি! লোকটি এমন প্ৰচণ্ড রসিক যে মহাপ্ৰতাপান্বিত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তাঁর রসিকতা করতে বাধে না। এমন লোক যদি আমার সঙ্গে একটু তামাসা করেন তাহলে আমার খুশি না হওয়াই তো ধৃষ্টতা!–তুমি এখন বাসায় যাও, আমি অন্য কাজে চললুম। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে পরামর্শ হবে।’
হ্যারিসন রোডে আসিয়া পড়িয়ছিলাম, ব্যোমকেশ লাফাইয়া একটা চলন্ত ট্রামে উঠিয়া পড়িল।
৩
সেদিন দুপুরবেলা ব্যোমকেশ আমাকে তাঁহার প্ল্যান প্রকাশ করিয়া বলিল।
প্ল্যান শুনিয়া বিশেষ আশাপ্ৰদ বোধ হইল না; এ যেন অজ্ঞাত পুকুরে মাছের আশায় ছিপ ফেলা, চারে মাছ আসিবে কিনা কোনও স্থিরতা নাই।
আমার মন্তব্য শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সে তো বটেই, অন্ধকারে ঢ়িল ফেলছি, লাগবে কিনা জানি না। যদি না লাগে তখন অন্য উপায় বার করতে হবে।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কমিশনার সাহেবের মত আছে?’
‘আছে।’
‘আমাকে কিছু করতে হবে?’
‘স্রেফ মুখ বুজে থাকতে হবে, আর কিছু নয়। আমি এখনই বেরিয়ে যাব; কারণ মরতে হলে আজই মরতে হয়, একটা দেশলায়ের বাক্স আর ক’দিন চলে? তুমি ইচ্ছে করলে কাল সকালে শ্রীরামপুরে গিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাস দর্শন করতে পার।’
‘ইতিমধ্যে এখানে যদি কেউ তোমার খোঁজ করে, তাকে কি বলব?’
‘বলবে, আমি গোপনীয় কাজে কলকাতার বাইরে গিয়েছি, কবে ফিরব ঠিক নেই।’
‘বীরেনবাবু আজ বিকেলে আসতে পারেন, তাঁকেও ঐ কথাই বলব?
কিয়ৎকাল ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, তাঁকেও ঐ কথাই বলবে। মোট কথা, এ সম্বন্ধে কোনও কথাই কইবে না।’
‘বেশ–মনে মনে একটু বিস্মিত হইলাম। বীরেনবাবু পুলিসের লোক, বিশেষত এ ব্যাপারে তিনিই এক প্রকার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী; তবু তাঁহার নিকট হইতেও গোপন করিতে হইবে কেন?
আমার অনুচ্চারিত প্রশ্ন যেন বুঝিতে পারিয়াই ব্যোমকেশ বলিল, ‘বীরেনবাবুকে না বলার কোনও বিশেষ কারণ নেই, মামুলি সতর্কতা। বর্তমানে তুমি আমি আর কমিশনার সাহেব ছাড়া এ প্ল্যানের কথা আর কেউ জানে না, অবশ্য কাল আরও কেউ কেউ জানতে পারবে। কিন্তু যতক্ষণ পারা যায় কথাটা চেপে রাখাই বাঞ্ছনীয়। চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন, মন্ত্রগুপ্তিই হচ্ছে কূটনীতির মুখবন্ধ; অতএব তুমি দৃঢ়ভাবে মুখ বন্ধ করে থাকবে।’