উপসংহার

ব্যোমকেশ প্রস্থান করিবার আধঘণ্টা পরে বীরেনবাবু ফোন করিলেন।

‘ব্যোমকেশবাবু কোথায়?’

‘তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন।’

‘কোথায় গেছেন?’

‘জানি না।’

‘কখন ফিরবেন?’

‘কিছুই ঠিক নেই। তিন চার দিন দেরি হতে পারে।’

‘তিন চার দিন। আজ সকালে আপনারা আমার বাসায় গিয়েছিলেন কেন?

ন্যাকা সাজিয়া বলিলাম‌, ‘তা জানি না।’

তারের অপর প্রান্তে বীরেনবাবু একটা অসন্তোষ-সূচক শব্দ করিলেন‌, ‘আপনি যে কিছুই জানেন না দেখছি। ব্যোমকেশবাবু কোন কাজে গেছেন তাও জানেন না?’

‘না।‘

বীরেনবাবু সশব্দে তার কাটিয়া দিলেন।

ক্ৰমে চারিটা বাজিল। পুঁটিরামকে চা তৈয়ার করিবার হুকুম দিয়া‌, এবার কি করিব ভাবিতেছি‌, এমন সময় দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল।

উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দেখিলাম‌, আমাদের পূর্বদিনের দগ্ধানন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহার হাতে একটি সংবাদপত্র।

তিনি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু বেরিয়েছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। আসুন।’

তাঁহার বিশেষ কোনও প্রয়োজন ছিল না‌, পূর্বদিনের আমন্ত্রণ স্মরণ করিয়া গল্পগুজব করিতে আসিয়াছিলেন। আমিও একলা বৈকালটা কি করিয়া কাটাইবি ভাবিয়া পাইতেছিলাম না‌, বোসজা মহাশয়কে পাইয়া আনন্দিত হইলাম।

বোসজা আসন পরিগ্ৰহ করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে‌, সেইটে আপনাদের দেখাতে এনেছিলুম। হয়তো আপনাদের চোখে পড়েনি—’ কাগজটা খুলিয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘দেখেছেন কি?’

সেই বিজ্ঞাপন। বড় দ্বিধায় পড়িলাম। মিথ্যা কথা বিশ্বাসযোগ্য করিয়া বলিতে পারি না‌, বলিতে গেলেই ধরা পড়িয়া যাই। অথচ ব্যোমকেশ চাণক্য-বাক্য উদ্ধৃত করিয়া মুখ বন্ধ রাখিতে উপদেশ দিয়া গিয়াছে। এইরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়িয়া কি বলিব ভাবিতেছি‌, এমন সময় বোসজা মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন‌, ‘পড়েছেন‌, অথচ ব্যোমকেশবাবু কোনও কথা প্রকাশ করতে মানা করে গেছেন–না?’

আমি চুপ করিয়া রহিলাম।

তিনি বলিলেন‌, ‘সম্প্রতি দেশলায়ের কাঠি নিয়ে একটা মহা গণ্ডগোল বেধে গেছে। এই সেদিন দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমা শেষ হল‌, তাতেও দেশলাই; আবার দেখছি দেশলাইয়ের বাক্সের বিজ্ঞাপন—মূল্য এক লক্ষ টাকা। সাধারণ লোকের মধ্যে স্বভাবতই সন্দেহ হয়‌, দুটোর মধ্যে কোনও যোগ আছে।’ বলিয়া সপ্রশ্ন চক্ষে আমার পানে চাহিলেন।

আমি এবারও নীরব হইয়া রহিলাম! কথা কহিতে সাহস হইল না‌, কি জানি আবার হয়তো বেফাঁস কিছু বলিয়া ফেলিব।

তিনি বলিলেন‌, ‘যাক ও কথা‌, আপনি হয়তো মনে করবেন। আমি আপনাদের গোপনীয় কথা বার করবার চেষ্টা করছি।’ বলিয়া অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

পুঁটিরাম চা দিয়া গেল। চায়ের সঙ্গে ক্রিকেট‌, রাজনীতি‌, সাহিত্য‌, নানাবিধ আলোচনা হইল। দেখিলাম লোকটি বেশ মিশুক ও সদালাপী—অনেক বিষয়ে খবর রাখেন।

এক সময় জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আচ্ছা‌, আপনার কি করা হয়? কিছু মনে করবেন না‌, আমাদের দেশে প্রশ্নটা অশিষ্ট নয়।’

তিনি একটু চুপ করিয়া বলিলেন‌, ‘সরকারী চাকরি করি।’

‘সরকারী চাকরি?’

‘হাঁ। তবে সাধারণ চাকরের মত দশটা চারটে অফিস করতে হয় না। চাকরিটা একটু বিচিত্র রকমের।’

‘ও—কি করতে হয়?’ প্রশ্নটা ভদ্ররীতিসম্মত নয় বুঝিতেছিলাম‌, তবে কৌতুহল দমন করিতে পারিলাম না।

তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘রাজ্য শাসন করবার জন্যে গভর্নমেন্টকে প্রকাশ্যে ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয়‌, অনেক খবর রাখতে হয়; নিজের চাকরদের ওপর নজর রাখতে হয়। আমার কাজ অনেকটা ঐ ধরনের।’

বিস্মিতকণ্ঠে বলিলাম‌, ‘সি আই ডি পুলিস?’

তিনি মৃদু হাসিলেন‌, ‘পুলিসের ওপরও পুলিস থাকতে পারে তো। আপনাদের এই বাসাটি দিব্যি নিরিবিলি‌, মেসের মধ্যে থেকেও মেসের ঝামেলা ভোগ করতে হয় না। কতদিন এখানে আছেন??

কথা পাল্টাইয়া লইলেন দেখিয়া আমিও আর কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না; বলিলাম‌, ‘আমি আছি বছর আষ্টেক‌, ব্যোমকেশ তার আগে থেকে আছে।’

তারপর আরো কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথাবার্তা হইল। তাঁহার মুখের এরূপ অবস্থা কি করিয়া হইল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন‌, কয়েক বছর আগে ল্যাবরেটরিতে কাজ করিতে করিতে হঠাৎ অ্যাসিডের শিশি ভাঙিয়া মুখে পড়িয়া যায়। সেই অবধি মুখের অবস্থা এইরূপ হইয়া গিয়াছে।

অতঃপর তিনি উঠিলেন। দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে হঠাৎ ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘দারোগা বীরেনবাবুর সঙ্গে আপনাদের জানাশোনা আছে। কেমন লোক বলতে পারেন?’

‘কেমন লোক? তাঁর সঙ্গে আমাদের কাজের সূত্রে আলাপ। তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে তো কিছু জানি না।‘

‘তাঁকে খুব লোভী বলে মনে হয় কি?’

‘মাফ করবেন ব্যোমকেশবাবু্‌, তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছুই বলতে পারি না।’

‘ও-আচ্ছা। আজ চললুম।’ তিনি প্ৰস্থান করিলেন। কিন্তু তাঁহার কথাগুলো আমার মনে কাঁটার মত বিঁধিয়া রহিল। বীরেনবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে ইনি অনুসন্ধিৎসু কেন? বীরেনবাবু কি লোভী? পুলিসের কর্মচারী সাধারণত অর্থগৃধ্নু হয় শুনিয়াছি। তবে বীরেনবাবু সম্বন্ধে কখনও কোনো কানাঘুষাও শুনি নাই। তবে এ প্রশ্নের তাৎপর্য কি? এবং গভর্নমেন্টের এই গোপন ভৃত্যটি কোন মতলবে আমাকে এই প্রশ্ন করিলেন?

পরদিন সকালে শয্যাত্যাগ করিয়াই খবরের কাগজ খুলিলাম। যাহা প্রত্যাশা করিয়াছিলাম তাহা বাহির হইয়াছে। বিজ্ঞাপন পৃষ্ঠার শুরুতেই রহিয়াছে—

“গতকল্য বৈকালে সাড়ে পাঁচটার সময় শ্রীরামপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এক অজ্ঞাত ভদ্রলোক যুবকের লাস পাওয়া গিয়াছে। মৃতদেহে কোথাও ক্ষতচিহ্ন নাই। মৃত্যুর কারণ এখনও অজ্ঞাত। মৃতের বয়স আন্দাজ ত্রিশ বৎসর‌, সুশ্ৰী চেহারা‌, গোঁফ দাড়ি কামানো। পরিধানে বাদামী রংয়ের গরম পাঞ্জাবি ও সাদা শাল ছিল। যুবক কলিকাতা হইতে ৪-৫৩ মিঃ লোকাল ট্রেনে শ্রীরামপুরে আসিয়াছিল; পকেটে টিকিট পাওয়া গিয়াছে। যদি কেহ লাস সনাক্ত করিতে পারেন, শ্রীরামপুর হাসপাতালে অনুসন্ধান করুন।“

0 Shares