উপসংহার

তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া কিছু জলযোগ করিয়া শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে বাহির হইলাম। দ্বিতলে নামিয়া একতলার সিঁড়িতে পদার্পণ করিতে যাইব‌, পিছু ডাক পড়িল‌, ‘অজিতবাবু্‌, সক্কাল না হতে কোথায় চলেছেন?’

দেখিলাম‌, ব্যোমকেশবাবু নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছেন। আজ আর মিথ্যা কথা বলিতে বাধিল না‌, বেশ সড়ৎ করিয়া বাহির হইয়া আসিল–’যাচ্ছি ডায়মন্ড হারবারে–এক বন্ধুর বাড়ি। ব্যোমকেশ কবে ফিরবে কিছু তো ঠিক নেই‌, দুদিন ঘুরে আসি।’

‘তা বেশ। আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?’

‘কালকেতু’খানা বগলে করিয়া লইয়াছিলাম‌, বলিলাম‌, না‌, গাড়িতে পড়তে পড়তে যাব।’ বলিয়া নামিয়া গেলাম।

রাস্তায় নামিয়া শিয়ালদহের দিকে কিছুদূর হাঁটিয়া গেলাম‌, তারপর সেখান হইতে ট্রাম ধরিয়া হাওড়া অভিমুখে রওনা হইলাম। নূতন মিথ্যা কথা বলিতে আরম্ভ করিলে একটু অসুবিধা এই হয় যে ধরা পড়িবার লজ্জাট সর্বদা মনে জাগারুক থাকে। ক্রমশ পরিপক্ক হইয়া উঠিলে বোধকরি ও দুর্বলতা কাটিয়া যায়।

যা হোক‌, হাওড়ায় ট্রেনে চাপিয়া বেলা সাড়ে ন’টা আন্দাজ শ্রীরামপুর পৌঁছিলাম।

হাসপাতালের সম্মুখে একটি ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন‌, তাঁহাকে লাসের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া অদূরে একটি ছোট কুঠরী নির্দেশ করিয়া দিলেন। কুঠরীটি মূল হাসপাতাল হইতে পৃথক‌, সম্মুখে একজন পুলিস প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে।

কাচ ও তার নির্মিত ক্ষুদ্র ঘরটির সম্মুখে গিয়া আমার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম; ভিতরে প্রবেশ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না। দেখিলাম‌, ঘরের মাঝখানে শানের মত লম্বা বেদীর উপরে ব্যোমকেশ শূইয়া আছে—তাহার পা হইতে গলা পর্যন্ত একটা কাপড় দিয়া ঢাকা। মুখখানা মৃত্যুর কাঠিন্যে স্থির।

আমি তাহার পাশে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিলাম‌, আবুহোসেন জাগো।’

ব্যোমকেশ চক্ষু খুলিল।

‘কতক্ষণ এইভাবে অবস্থান করছ?’

‘প্রায় দুঘণ্টা। একটা সিগারেট পেলে বড় ভাল হত।’

‘অসম্ভব। মৃত ব্যক্তি পিণ্ডি খেতে পারে শুনেছি‌, কিন্তু সিগারেট খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।’

‘ঠিক জানো? মনুসংহিতায় কোনও বিধান নেই?’

‘না। তারপর‌, ক’জন লোক দেখতে এল?’

‘মাত্র তিনজন। স্থানীয় লোক‌, নিতান্তই লোফার ক্লাশের।’

‘তবে?’

‘এখনও হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। আজ সারাদিন আছে।–কালকেও অন্তত সকালবেলাটা পাওয়া যাবে।’

‘দুদিন ধরে এইখানে পড়ে থাকবে? মনে কর যদি বিজ্ঞাপনটা তাঁর চোখে না পড়ে? ‘

‘চোখে পড়তে বাধ্য। তিনি এখন অনবরত বিজ্ঞাপন অন্বেষণ করছেন।’

‘তা বটে! যা হোক‌, এখন আমি কি করব বল দেখি।’

‘তুমি এই ঘরের কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে বসে থাক‌, যারা আসছে তাদের ওপরে লক্ষ্য রাখ। অবশ্য পুলিস নজর রেখেছে; যিনি এই হতভাগ্যকে পরিদর্শন করতে আসছেন তাঁরই পিছনে গুপ্তচর লাগছে। কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়। তুমি যদি কোনো চেনা লোক দেখতে পাও‌, তখনি এসে আমাকে খবর দেবে। আমার মুশকিল হয়েছে চোখ খুলতে পারছি না‌, কাজেই যাঁরা এখানে পায়ের ধুলো দিচ্ছেন তাঁদের শ্ৰীমুখ দর্শন করা হচ্ছে না। মড়া যদি মিটমিট করে তাকাতে আরম্ভ করে তাহলে বিষম হৈ চৈ পড়ে যাবে কিনা।’

‘বেশ। আমি কাছাকাছি রইলুম। পুলিস আবার হাঙ্গামা করবে না তো?’

‘দ্বারের প্রহরীকে চুপি চুপি নিজের পরিচয় দিয়ে যেও‌, তাহলে আর হাঙ্গামা হবে না। তিনি একটি বর্ণচোরা আম; দেখতে পুলিস কনেস্টবল বটে। কিন্তু আসলে একজন সি আই ডি দারোগা।‘

বাহিরে আসিয়া ছদ্মবেশী প্রহরীকে আত্মপরিচয় দিলাম; তিনি অদূরে একটি মোতির ঝাড় দেখাইয়া দিলেন। মোতির ঝাড়টি এমন জায়গায় অবস্থিত যে তাহার আড়ালে লুকাইয়া বসিলে ব্যোমকেশের কুঠরীর দ্বার পরিষ্কার দেখা যায়‌, অথচ বাহির হইতে ঝোপের ভিতরে কিছু আছে কিনা বোঝা যায় না।

ঝোপের মধ্যে গিয়া বসিলাম। চারিদিক ঘেরা থাকিলেও মাথার উপর খোলা; দিব্য আরামে রোদ পোহাইতে পোহাইতে সিগারেট ধরাইলাম।

ক্ৰমে বেলা যত বাড়িতে লাগিল‌, দৰ্শন-অভিলাষী লোকের সংখ্যাও একটি দুইটি করিয়া বাড়িয়া চলিল। উৎসুকভাবে তাঁহাদের পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। সকলেই অপরিচিত‌, চেহারা দেখিয়া বোধ হইল‌, অধিকাংশই বেকার লোক একটা নূতন ধরনের মজা পাইয়াছে।

ক্রমে এগারোটা বাজিল‌, মাথার উপর সূর্যদেব প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। র‍্যাপারটা মাথায় চাপা দিয়া বসিয়া রহিলাম। একটা নৈরাশ্যের ভাব ধীরে ধীরে মনের মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। যে-ব্যক্তি দেশলাই চুরি করিয়াছে‌, সে শ্রীরামপুরে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাস দেখিতে আসিবে কেন? আর‌, যদি বা আসে‌, এতগুলো লোকের মধ্যে তাহাকে দেশলাই-চোর বলিয়া চিনিয়া লওয়া যাইবে কিরূপে? সত্য‌, সকলের পিছনেই পুলিস লাগিবে‌, কিন্তু তাঁহাতেই বা কি সুবিধা হইতে পারে? মনে হইল‌, ব্যোমকেশ বৃথা পণ্ডশ্ৰম করিয়া মরিতেছে।

ব্যোমকেশের ঘরের দিকে চাহিয়া এই সব কথা ভাবিতেছিলাম‌, হঠাৎ চমক ভাঙিয়া গেল। একটি লোক দ্রুতপদে আসিয়া কুঠরীতে প্রবেশ করিল; বোধহয় পাঁচ সেকেন্ড। পরেই আবার বাহির হইয়া আসিল–প্রহরীর প্রশ্নে একবার মাথা নাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

লোকটি আমাদের মেসের নূতন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহাকে দেখিয়া এতই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলাম যে তিনি চলিয়া যাইবার পরও কিয়ৎকাল বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে বসিয়া রহিলাম তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া সেই ঘরের অভিমুখে ছুটিলাম।

0 Shares