উপসংহার

ব্যোমকেশ বোধকরি আমার পদশব্দ শুনিয়া আবার মড়ার মত পড়িয়া ছিল‌, আমি তাহার কাছে গিয়া উত্তেজিত স্বরে বলিলাম‌, ‘ওহে‌, কে এসেছিলেন জানো? তোমার মিতে–মেসের সেই নূতন ব্যোমকেশবাবু।’

ব্যোমকেশ সটান উঠিয়া বসিয়া আমার পানে বিস্ফারিত নেত্ৰে তাকাইল। তারপর বেদী হইতে লাফাইয়া নীচে নামিয়া বলিল‌, ‘ঠিক দেখেছ? কোনও ভুল নেই?’

‘কোনও ভুল নেই।’

‘যাঃ‌, এতক্ষণে হয়তো পালাল।’

ব্যোমকেশের গায়ে জামা কাপড় ছিল বটে। কিন্তু জুতা পায়ে ছিল না‌, সেই অবস্থাতেই সে বাহিরের দিকে ছুটিল। হাসপাতালের সম্মুখে যে ভদ্রলোকটিকে আমি দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলাম, তিনিও তখনও সেখানে ছিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায় গেল? এখনি যে-লোকটা এসেছিল?’

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিচলিত হইয়া বলিলেন‌, ‘সেই নাকি?’

‘হ্যাঁ–তাকেই গ্রেপ্তার করতে হবে।’

ভদ্রলোক মাথায় হাত দিয়া বলিলেন‌, ‘সে পালিয়েছে।’

‘পালিয়েছে?’

‘সে কলকাতা থেকে ট্যাক্সিতে এসেছিল‌, আবার ট্যাক্সিতে চড়ে পালিয়েছে। আমাদের মোটর-বাইকের বন্দোবস্ত করা হয়নি‌, তাই—’

দাঁতে দাঁত ঘষিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এর জবাবদিহি আপনি করবেন।—এস অজিত‌, যদি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়–হয়তো এখনও–’

কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। অগত্যা বাসে চড়িয়াই কলিকাতা যাত্ৰা করিলাম।

পথে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘উনিই তাহলে?’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, ‘হুঁ।’

‘কিন্তু বুঝলে কি করে?’

‘সে অনেক কথা-পরে বলব।‘

‘আচ্ছা‌, উনি অত তাড়াতাড়ি পালালেন কেন? তুমি যদি মরে গিয়েই থাকো—’

‘উনি শিকারী বেড়াল‌, ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝেছিলেন যে ফাঁদে পা দিয়েছেন। তাই চট্‌পট্‌ সরে পড়লেন।’

সাড়ে বারোটার সময় মেসে পৌঁছিয়া দ্বিতলে উঠিয়া দেখিলাম সিঁড়ির মুখে মেসের ম্যানেজার দাঁড়াইয়া আছেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু এসেছিলেন?’

ম্যানেজার সবিস্ময়ে নগ্নপদে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন‌, ‘দু নম্বর ব্যোমকেশবাবু? তিনি তো এই খানিকক্ষণ হল চলে গেলেন। বাড়ি থেকে জরুরী খবর পেয়েছেন‌, তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। তিনিও আপনার খোঁজ করছিলেন। আপনাকে নমস্কার জানিয়ে গেছেন। বলে গেছেন‌, আপনি যেন দুঃখ না করেন‌, শীগগির আবার দেখা হবে।’

শিষ্টতার এই প্ৰবল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাঁর ঘর কোনটা?’

‘ঐ যে পাঁচ নম্বর ঘর।’

পাঁচ নম্বর ঘরের দ্বারে তালা লাগানো ছিল‌, ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এর চাবি কোথায়?’

ম্যানেজার বলিলেন‌, ‘আমার কাছে একটা চাবি আছে‌, কিন্তু—‘

‘খুলুন।’

চাবির থোলো পকেট হইতে বাহির করিতে করিতে ম্যানেজার উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিলেন‌, ‘কি–কি হয়েছে ব্যোমকেশবাবু?’

‘বিশেষ কিছু নয়; যে ভদ্রলোকটি এই ঘরে ছিলেন তিনি একজন দাগী আসামী।’

ম্যানেজার তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া ব্যোমকেশ একবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল‌, ‘তিনি তো কিছুই নিয়ে যাননি দেখছি। বাক্স বিছানা সবই রয়েছে।’

ম্যানেজার বলিলেন‌, ‘তিনি কেবল ছোট হ্যান্ডব্যাগ আর জলের কুঁজে নিয়ে গেছেন–আর সবই রেখে গেছেন। বললেন‌, দুচার দিনের মধ্যে ফিরবেন‌, আমিও ভাবলুম–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঠিক কথা। আপনি এবার থানার দারোগা বীরেনবাবুর কাছে খবর পাঠান—তাঁকে জানান যে চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে‌, তিনি যেন শীগগির আসেন। —আমরা ততক্ষণে এই ঘরটা একবার দেখে নিই।’

ম্যানেজার প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। এই মেসের প্রায় সব ঘরগুলিই বড় বড়‌, প্রত্যেকটিতে দু’ বা তিনজন করিয়া ভদ্রলোক থাকিতেন। কেবল এই পাঁচ নম্বর ঘরটি ছিল ছোট‌, একজনের বেশি থাকা চলিত না। ভাড়াও কিছু বেশি পড়িত‌, তাই ঘরটা অধিকাংশ সময় খালি পড়িয়া থাকিত। যিনি মেসে থাকিয়াও স্বাতন্ত্র্য ও নিভৃততা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক তাঁহার পক্ষে ঘরটি চমৎকার।

ঘরে গোটা দুই ট্রাঙ্ক ও বিছানা ছাড়া আর বিশেষ কিছু ছিল না। ব্যোমকেশ বিছানাটা পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘শীতের সময়‌, অথচ লেপ তোষক বালিশ কিছুই নিয়ে যাননি। অর্থাৎ–বুঝেছ?’

‘না। কি?’

‘অন্যত্র আর একসেট বন্দোবস্ত আছে।’

ব্যোমকেশ বিছানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল‌, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তুমি কি আশা করছি দেশলায়ের বাক্সটা তিনি এই ঘরে রেখে গেছেন?’

‘না।–তাহলে তিনি ফিরে এলেন কেন? আমি খুঁজছি। তার বর্তমান ঠিকানা; যদি কোথাও কিছু পাই যা-থেকে তাঁর প্রকৃত নামধামের কিছু ইশারা পাওয়া যায়। তাঁর সত্যিকারের নাম যে ব্যোমকেশ বসু নয় এটা বোধ হয় তুমিও এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে।’

‘মানে—কি বলে—হ্যাঁ, পেরেছি বৈকি। কিন্তু ‘ব্যোমকেশ’ ছদ্মনাম গ্রহণ করবার উদ্দেশ্য কি?’

বিছানার উপর বসিয়া ব্যোমকেশ ঘরের এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে বলিল‌, ‘উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা সাধন। অজিত‌, প্রতিহিংসার মনস্তত্ত্বটা বড় আশ্চর্য। তুমি গল্প-লেখক‌, সুতরাং মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সবই জানো। তোমাকে বলাই বাহুল্য যে নেপথ্য থেকে প্ৰতিহিংসা সাধন করে মানুষ সুখ পায় না; প্রত্যেকটি আঘাতের সঙ্গে সে জানিয়ে দিতে চায় যে সে প্রতিহিংসা নিচ্ছে। শত্ৰু যদি জানতে না পারে কোথা থেকে আঘাত আসছে‌, তাহলে প্রতিহিংসার অর্ধেক আনন্দই ব্যর্থ হয়ে যায়। ইনি তাই একেবারে আমার বুকের ওপর এসে চেপে বসেছিলেন। এটা যদি সুসভ্য বিংশ শতাব্দী না হয়ে প্রস্তর-যুগ হত‌, তাহলে এত ছল চতুরীর দরকার হত না‌, উনি একেবারে পাথরের মুগুর নিয়ে আমার মাথায় বসিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন সেটা চলে না‌, ফাঁসি যাবার ভয় রয়েছে। মোট কথা‌, প্ৰতিহিংসার পদ্ধতিটা বদলেছে বটে। কিন্তু মনস্তত্ত্বটা বদলায়নি। আজ যে উনি আমার মৃত মুখখানা দেখবার জন্যে শ্রীরামপুরে ছুটেছিলেন‌, সেও ওই একই মনোভাবের দ্বারা পরিচালিত হয়ে।’ ব্যোমকেশ খামখেয়ালী গোছের হাসিল–’চিঠিখানার কথা মনে আছে তো‌, সেটা আমারই উদ্দেশ্যে লেখা এবং উনি নিজেই লিখেছিলেন। তার বাহ্য কৃতজ্ঞতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল অতি ক্রূর ইঙ্গিত। তিনি যতদূর সম্ভব পরিষ্কার ভাবেই লিখে জানিয়েছিলেন যে তিনি ভোলেননি–ঋণ পরিশোধ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছেন। আমরা অবশ্য তখন চিঠির মানে ভুল বুঝেছিলাম‌, তবু–আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। তোমার বোধহয় মনে আছে।’

0 Shares