সেই চিঠিতে লিখিত কথাগুলো যেন এখন নূতন চক্ষে দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, ‘মনে আছে। কিন্তু তখন কে জানত–; আচ্ছা, লোকটা তোমার কোনও পুরনো শত্ৰু–না?’
‘তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।’
‘লোকটা কে তা কিছু বুঝতে পারছি না?’
‘বোধহয় একটু একটু পারছি। কিন্তু এখন ও কথা যাক, আগে তাঁর বাক্সগুলো দেখি।’
একটা বাক্সের চাবি খোলাই ছিল, তাহাতে দৈনিক ব্যবহার্যকাপড়-চোপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। অন্যটার তালা লইয়া ব্যোমকেশ দু’একবার নাড়াচাড়া করিয়া একটু চাপ দিতেই সেটাও খুলিয়া গেল। ভিতরে কয়েকটা গরম কোট পাঞ্জাবি ইত্যাদি রহিয়াছে। সেগুলা বাহির করিয়া তলায় অনুসন্ধান করিতে এক শিশি স্পিরিট-গাম ও কিছু বিনুনিকরা ক্রেপ চুল বাহির হইয়া পড়িল। সেগুলি তুলিয়া ধরিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ, মুখে যার অ্যাসিড ছাপ মেরে দিয়েছে তাকে মাঝে মাঝে গোঁফ দাড়ি পরে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয় বৈকি। এই সব পরে সম্ভবত ইনি ট্রামে আমার দেশলাই বদলে নিয়েছিলেন।’
ক্ৰেপ ইত্যাদি সরাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ আবার কয়েকটা জিনিস দুই হাতে বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিল, বলিল, ‘কিন্তু এগুলো কি?’
মোমজামার মত খানিকটা কাপড়ে কি কতকগুলা জড়ানো রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সাবধানে সেগুলা মেঝের উপর রাখিয়া মোড়ক খুলিল। একটি আধা আউন্সের খালি শিশি, কয়েকখণ্ড সীলমোহর করিবার লাল রংয়ের গালা ও অর্ধ-দগ্ধ একটি মোমবাতি রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ শিশির ছিপি খুলিয়া আঘ্রাণ গ্ৰহণ করিল, মোমবাতি ও গালা খুব মনোযোগের সহিত দেখিল, শেষে, মোমজামাটা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল। দেখিলাম সাধারণ মোমজামা নয়, খুব ভাল জাতীয় ওয়াটারপ্রুফ কাপড়–ঈষৎ নীলাভ এবং স্বচ্ছ-আয়তনে একটা রুমালের মত। বর্তমানে তাহার একটা কোণের প্রায় সিকি ভাগ কাপড় নাই–মনে হয় কোনও কারণে ছিঁড়িয়া লওয়া হইয়াছে।
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘শিশি, গালা, মোমবাতি এবং ওয়াটারপ্রুফের একত্র সমাবেশ।
মানে বুঝতে পারলে?’
‘না–কি মানে?’
‘ওয়াটারপ্রুফ থেকেও কিছু আন্দাজ করতে পারলে না?’
হতাশভাবে বলিলাম, ‘কিছু না। তুমি কি বুঝলে?’
‘সবই বুঝেছি, শুধু ভদ্রলোকের বর্তমান ঠিকানা ছাড়া।–চল, এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে।’
এই সময় ম্যানেজারবাবু ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন, ‘দারোগাবাবুকে খবর দিয়েছি, তিনি এলেন বলে।‘
‘বেশ।–আচ্ছা ম্যানেজারবাবু্, আমার এই মিতেটি যখন চলে গেলেন তখন আপনি নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে সদর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, গিয়েছিলুম।’
‘ট্যাক্সির নম্বরটা আপনার চোখে পড়েনি?’
মাথা নাড়িয়া ম্যানেজার বলিলেন, ‘আজ্ঞে না। নীল রঙের পুরনো ট্যাক্সি—ড্রাইভার একজন শিখ—এইটুকুই লক্ষ্য করেছিলুম।’
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সে সময় দোরের কাছে আর কেউ ছিল?’
ম্যানেজার ভাবিয়া বলিলেন, ‘ভদ্রলোক কেউ ছিলেন বলে তো মনে পড়ছে না, তবে আপনাদের চাকর পুঁটিরাম দাওয়ায় বসেছিল। আপনারা বাসায় ছিলেন না, তাই সে বোধহয় একটু—’
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুঁটিরাম থাকা না-থাকা সমান। সে তো আর ইংরিজি জানে না, কাজেই ট্যাক্সির নম্বর চোখে দেখলেও পড়তে পারবে না।–চল অজিত, দেড়টা বাজল, পেটও বাপান্ত করছে। ম্যানেজারবাবু্, এবেলা দুটি ভাত আমাদের দিতে হবে। অবশ্য যদি অসুবিধা না হয়।’
ম্যানেজার সানন্দে বলিলেন, ‘বিলক্ষণ! অসুবিধে কিসের! ব্যোমকেশবাবুর-মানে, দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর–ভাত হাঁড়িতেই আছে, তিনি তো খাননি। আপনারা স্নান করুনগে, আমি ভাত পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘মন্দ ব্যবস্থা নয়। দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর বাড়া ভাত এক নম্বর ব্যোমকেশবাবু খাবেন। দুনিয়াতে এই ব্যাপার তো হরদম চলছে—কি বল অজিত? এখন দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু কোথায় বসে কার ভাত খাচ্ছেন সেইটে জানতে পারলে বড় খুশি হতুম।’
আহার তখনো শেষ হয় নাই, বীরেনবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোনও রকমে অন্ন গলাধঃকরণ করিয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিতেই বীরেনবাবু উঠিয়া প্রশ্ন-ব্যাকুল নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে তাকাইলেন। তাহার সমস্ত দেহ একটা জীবন্ত জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার ধারণ করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার এখনো খাওয়া হয়নি দেখছি।’
‘না। খাবার জন্যে বাড়ি যাচ্ছিলুম। এমন সময় আপনার ডাক পেলুম। —কি হল ব্যোমকেশবাবু? ধরেছেন তাকে?’
‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে কিছু খাবার আনিয়ে দিই।’
‘খাবার দরকার নেই। তবে যদি এক পেয়াল চা–?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বেশ। এবং সেই সঙ্গে দুটো নিষিদ্ধ ডিম। —পুঁটিরাম।’
পুঁটিরাম হুকুম লইয়া প্রস্থান করিলে পর, ব্যোমকেশ বীরেনবাবুকে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করিয়া বলিল। তাঁহাকে না বলিয়া এত কাজ করা হইয়াছে, ইহাতে বীরেনবাবু একটু আহত হইলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে যথা সম্ভব মিষ্ট করিয়া সাত্ত্বিনা দিল, তথাপি তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বলিলেন, ‘আমি যদি জানতুম তাহলে সে এমন হাত-ফসকে পালাতে পারত না। এখন তাকে ধরা কঠিন হবে। এতক্ষণে সে হয়তো কলকাতা থেকে বহু দূরে চলে গেছে।’
ব্যোমকেশ মেঝের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমার কিন্তু মনে হয় সে কলকাতাতেই আছে। কারণ সে মার্কা-মারা লোক, ওরকম মুখ নিয়ে মানুষ বেশি দূর পালাতে পারে না। কলকাতা শহরই তার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ।’