১
যে শহরে আমি ও ব্যোমকেশ হপ্তাখানেকের জন্য প্রবাসযাত্ৰা করিয়াছিলাম তাহাকে কয়লা-শহর বলিলে অন্যায় হইবে না। শহরকে কেন্দ্ব করিয়া তিন-চার মাইল দূরে দূরে গোটা চারেক কয়লার খনি। শহরটি যেন মাকড়সার মত জাল পাতিয়া মাঝখানে বসিয়া আছে, চারিদিক হইতে কয়লা আসিয়া রেলওয়ে স্টেশনে জমা হইতেছে এবং মালগাড়িতে চড়িয়া দিগবিদিকে যাত্ৰা করিতেছে। কর্মব্যস্ত সমৃদ্ধ শহর; ধনী ব্যবসায়ীরা এখানে আসিয়া আড্ডা গাড়িয়াছে, কয়েকটি বড় বড় ব্যাঙ্ক আছে, উকিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দালাল মহাজনের ছড়াছড়ি। পথে মোটর ট্যাক্সি বাস ট্রাকের ছুটাছুটি। কাঁচা মালের সহিত কাঁচা পয়সার অবিরাম বিনিময়। শহরটিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেছে-কয়লা। চারিদিকে কয়লার কীর্তন, কয়লার কলকোলাহল। শহরটি মোটেই প্রাচীন নয়, কিন্তু দেখিয়া মনে হয় অদৃশ্য কয়লার গুড়া ইহার সর্বাঙ্গে অকালবার্ধক্যের ছায়া ফেলিয়াছে।
যাঁহার আহ্বানে আমরা এই শহরে আসিয়াছি তিনি ফুলঝুরি নামক একটি কয়লাখনির মালিক, নাম মণীশ চক্রবর্তী। কয়েক মাস যাবৎ তাঁহার খনিতে নানা প্রকার প্রচ্ছন্ন উৎপাত আরম্ভ হইয়াছিল। খনির গর্ভে আগুন লাগা, মূল্যবান যন্ত্রপাতি ভাঙ্গিয়া নষ্ট হওয়া ইত্যাদি দুর্ঘটনা ঘটিতেছিল; কুলি-কাবাড়িদের মধ্যেও অহেতুক অসন্তোষ দেখা দিয়াছিল। একদল লোক তাঁহার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই; এরূপ অবস্থায় যাহা মনে করা স্বাভাবিক তাহাই মনে করিয়া মণীশবাবু পুলিস ডাকিয়াছিলেন। অনেক নূতন লোককে বরখাস্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। শেষ পর্যন্ত গোপনে ব্যোমকেশকে আহ্বান করিয়াছিলেন।
একটি চৈত্রের সন্ধ্যায় আমরা মণীশবাবুর গৃহে উপনীত হইলাম। শহরের অভিজাত অঞ্চলে প্রশস্ত বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি। মণীশবাবু সবেমাত্র খনি হইতে ফিরিয়াছেন, আমাদের সাদর সম্ভাষণ করিলেন। মণীশবাবুর বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, গৌরবর্ণ সুপুরুষ, এখনও শরীর বেশ সমর্থ আছে। চোয়ালের হাড়ের কঠিনতা দেখিয়া মনে হয় একটু কড়া মেজাজের লোক।
ড্রয়িং-রুমে বসিয়া কিছুক্ষণ কথাবাতার পর মণীশবাবু বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, এখানে কিন্তু আপনাদের ছদ্মনামে থাকতে হবে। আপনার নাম গগনবাবু্, আর অজিতবাবুর নাম সুজিতবাবু। আমার আসল নাম চলে সকেলই বুঝতে পারবে আপনার কী উদ্দেশে এসেছে। সেটা বাঞ্ছনীয় নয়।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বেশ তো, এখানে যতদিন থাকব। গগনবাবু সেজেই থাকব। অজিতেরও সুজিত সাজতে আপত্তি নেই।’
দ্বারের কাছে একটি যুবক দাঁড়াইয়া অস্বচ্ছন্দভাবে ছট্ফট করিতেছিল, বোধহয় ব্যোমকেশের সহিত পরিচিত হইবার জন্য প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিল। মণীশবাবু ডাকিলেন, ‘ফণী।’
যুবক উদগ্ৰীবিভাবে ঘরে প্রবেশ করিল। মণীশবাবু আমাদের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আমার ছেলে ফণীশ। —ফণী, তুমি জানো এরা কে, কিন্তু বাড়ির বাইরে আর কেউ যেন জানতে না পারে।’
ফণীশ বলিল, ‘আজ্ঞে না।’
‘তুমি এবার এঁদের গোস্ট-রুমে নিয়ে যাও। দেখো যেন ওঁদের কোনো অসুবিধা না হয়।–আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, চা তৈরি হচ্ছে।
ড্রয়িং-রুমের লাগাও গোস্ট-রুম। বড় ঘর, দুটি খাট! টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি উপযোগী আসবাবে সাজানো, সংলগ্ন বাথরুম। ফণীশ আমাদের ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল ।
ছেলেটিকে কেশ শান্তশিষ্ট এবং ভালোমানুষ ঋলিয়া মনে হয়। বাপের মতই সুপুরুষ, কিন্তু দেহ-মনের পূর্ণ পরিণতি ঘটিতে এখনও বিলম্ব আছে; ভাবভঙ্গীতে একটু ছেলেমানুষীর রেশ রহিয়া গিয়াছে । বয়স আন্দাজ তেইশ-চব্বিশ।
কেশবাস পরিবর্তন করিতে করিতে দুই-চারিটিা কথা হইল; ফণীশ লাজুকভাবে ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তর দিল। সে পিতার একমাত্র সন্তান, এক বছর আগে তাহার বিবাহ হইয়াছে। সে প্রত্যহ পিতার সঙ্গে কয়লাখনিতে গিয়া কাজকর্ম দেখাশুনা করে। লক্ষ্য করিলাম, ব্যোমকেশের কথার উত্তর দিতে দিতে সে যেন একটা অন্য কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু বলিতে গিয়া সংকোচবেশে থামিয়া যাইতেছে।
ফণীশ কী বলিতে চায় শোনা হইল না, আমরা বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। ইতিমধ্যে চা ও জলখাবার উপস্থিত হইয়াছে; আমরা বসিয়া গোলাম।
চায়ের আসরে কিন্তু মেয়েদের দেখিলাম না, কেবল আমরা চারজন। অথচ বাড়িতে অন্তত দুইটি স্ত্রীলোক নিশ্চয় আছেন। মণীশবাবু বোধকরি পুরাপুরি স্বদেশীবৰ্জন করেন না। তা আজকালকার সাড়ে-বত্রিশ-ভাজার যুগে একটু অন্তরাল থাকা মন্দ কি ?
পানাহার শেষ করিয়া সিগারেট ধরিইয়াছি, একটি প্রকাণ্ড গাড়ি আসিয়া বাড়ির সামনে থামিল। গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। গেরিলার মত চেহারা, কালিমাবেষ্টিত লোক দুইটিতে মন্থর কুটিলতা। মুখ দেখিয়া চরিত্র অধ্যয়ন যদি সম্ভব হইত বলিতাম লোকটি মাহাপাপিষ্ঠ।
মণীশবাবু খুব খাতির করিয়া আগস্তুককে ঘরে আনিলেন, আমাদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘ইনি শ্রীগোবিন্দ হালদার, এখানকার একটি কয়লাখনির মালিক। এঁরা হচ্ছেন শ্ৰীগগন মিত্র এবং সুজিত কন্দ্যোপাধ্যায় ; আমার বন্ধু, কলকাতায় থাকল। বেড়াতে এসেছেন।’
গোবিন্দবাবু তাঁহার শনৈশ্চর চক্ষু দিয়া আমাদের সমীক্ষণ করিতে করিতে মণীশবাবুকে বলিলেন, ‘খবর নিতে এলাম। খনিতে আর কোনো গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?’
মণীশবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, ‘গণ্ডগোল তো লেগেই আছে। পরশু রাত্রে এক কাণ্ড। হঠাৎ পাঁচ নম্বর পিট্-এর পাম্প বন্ধ হয়ে গেল। ভাগ্যে পাহারাওয়ালার সজাগ ছিল তাই বিশেষ অনিষ্ট হয়নি। নইলে—’