কহেন কবি কালিদাস

এ দরজাটাও নূতন মজবুত দরজা। প্রাণহরি পোদ্দার ঘরটিকে দুর্গের মত সুরক্ষিত করিয়াছিলেন‌, কারণ সিন্দুকে মাল আছে।

ব্যোমকেশ দরজা খুলিল। সঙ্কীর্ণ ঘরে পিছনের দেয়ালে একটি ঘুলঘুলি দিয়া আলো আসিতেছে‌, ঘুলঘুলির নীচে সরু একটি দরজা। ঘরে একটি শূন্য বালতি ও টিনের মগ ছাড়া আর কিছু নাই।

সরু দরজার উপরে-নীচে ছিটুকিনি লাগানো। ব্যোমকেশ ছিটুকিনি খুলিয়া কপাট ফাঁক করিল। উঁকি মারিয়া দেখিলাম‌, দ্বারের মুখ হইতে শীর্ণ লোহার। মই মাটি পর্যন্ত গিয়াছে। মেথরখাটা রাস্তা; প্রাণহারির দুর্গে প্রবেশ করিবার দ্বিতীয় পথ।

ব্যোমকেশ বরাটকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি সে-রাত্রে যখন প্রথম এসেছিলেন‌, এ দরজা দুটো বন্ধ ছিল?’

বরাট বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ, দুটোই বন্ধ ছিল। কেবল সামনে সিঁড়ির দরজা খোলা ছিল।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, চলুন‌, এবার নীচে যাওয়া যাক। মেয়েটাকে দুচারটে প্রশ্ন করে দেখি।’

ড্রয়িং-রুমের মত সাজানো নীচের তলার যে-ঘরটাতে তাস খেলা হইত। সেই ঘরে আমরা বসিয়াছি। মোহিনী একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া আমাদের সামনে দাঁড়াইয়া আছে‌, তাহার মুখে ভয় বা উদ্বেগের চিহ্ন নাই‌, ভাবভঙ্গী বেশ সংযত এবং সংবৃত।

মনে মনে প্রাণহারির নিরাভরণ শয়নকক্ষের সহিত সুসজ্জিত ড্রয়িং-রুমের তুলনা করিতেছি‌, ব্যোমকেশ মোহিনীকে প্রশ্ন করিল‌, ‘তুমি প্রাণহারিবাবুর কাছে কতদিন চাকরি করছ?’

মোহিনী বলিল‌, ‘দুবছরের বেশি।’

‘প্রাণহারিবাবু যখন কটকে ছিলেন তখন থেকে তুমি ওঁর কাছে আছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘প্রাণহারিবাবুর আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে?’

‘জানি না। কখনো দেখিনি।’

‘তুমি কত মাইনে পাও?’

‘কটকে ছিল দশ টাকা মাইনে আর খাওয়া-পরা। এখানে আসার পর পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’

‘প্রাণহরিবাবু কেমন লোক ছিলেন?’

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া মোহিনী বলিল‌, ‘তিনি আমার মালিক ছিলেন‌, ভাল লোকই ছিলেন।’ অর্থাৎ‌, তিনি আমার মালিক ছিলেন তাঁহার নিন্দা করিব না‌, তোমরা বুঝিয়া লও।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনি কৃপণ ছিলেন?’

মোহিনী চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ স্থিরনেত্রে তাহার পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘তোমার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কি রকম ছিল?

মোহিনী একটু বিস্ময়ভরে ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল‌, তাহার ঠোঁটের কোণে যেন একটু চটুলতার ঝিলিক খেলিয়া গেল। তারপর সে শান্তস্বরে বলিল‌, ‘ভালই ছিল। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুঁ। তাঁর স্ত্রীলোক-ঘটিত কোনো দোষ ছিল?’

‘আজ্ঞে না। বুড়োমানুষ ছিলেন‌, ওসব দোষ ছিল না। কেবল তাস খেলার নেশা ছিল। একলা বসে বসে তাস খেলতেন।’

‘যাক। তুমি এখন নিজের কথা বল। প্রাণহারিবাবু খুন হয়েছেন‌, তা সত্ত্বেও তুমি একলা এ বাড়িতে পড়ে আছ কেন?

‘কোথায় যাব? এ শহরে তো আমার কেউ নেই।’

‘দেশে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’

‘তাই যাব। কিন্তু দারোগাবাবু হুকুম দিয়েছেন যতদিন না খুনের কিনারা হয় ততদিন কোথাও যেতে পার না।’

‘দেশে তোমার কে আছে।’

‘বুড়ো মা-বাপ আছে।’

‘আর স্বামী?

মোহিনী চকিতে চোখ তুলিয়া আবার চোেখ নীচু করিয়া ফেলিল‌, প্রশ্নের উত্তর দিল না।

‘বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়?’

মোহিনী নীরবে ঘাড় নাড়িল।

‘স্বামী কোথায়?’

মোহিনী ঘাড় তুলিয়াই ধীরে ধীরে উত্তর দিল‌, ‘স্বামী ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে‌, আর ফিরে আসেনি।’

ব্যোমকেশ তাহার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখিয়া সিগারেট ধরাইল, ‘কতদিন হল স্বামী ঘরছাড়া হয়েছে?’

‘তিন বছর।’

‘স্বামী কী কাজ করত?

‘কল-কারখানায় কাজ করত।’

‘বিবাগী হয়ে গেল কেন?’

মোহিনীর অধরোষ্ঠ একটু প্রসারিত হইল‌, সে ব্যোমকেশের প্রতি একটি চকিত চপল কটাক্ষ হানিয়া বলিল‌, ‘জানি না।’

ইহাদের প্রশ্নোত্তর শুনিতে শুনিতে এবং মোহিনীকে দেখিতে দেখিতে ভাবিতেছি‌, মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র কেমন? সচ্চরিত্রা‌, না স্বৈরিণী? সে যে-শ্রেণীর মেয়ে তাহদের মধ্যে একনিষ্ঠা ও পতিব্রত্যের স্থান খুব উচ্চ নয়। ঐহিক প্রয়োজনের তাড়নায় তাহাদের জীবন বিপথে-কুপথে সঞ্চরণ করে। অথচ মোহিনীকে দেখিয়া ঠিক সেই জাতীয় সাধারণ বি-চাকরানী শ্রেণীর মেয়ে বলিয়া মনে হয় না। কোথায় যেন একটু তফাৎ আছে। তাহার যৌবন-সুলভ চপলতা চটুলতার সঙ্গে চরিত্রের দৃঢ়তা ও সাহস আছে। এ মেয়ে যদি নষ্ট-দুষ্ট হয়‌, সজ্ঞানে জানিয়া বুঝিয়া নষ্ট-দুষ্ট হইবে‌, বাহ্য প্রয়োজনের তাগিদে নয়।

ব্যোমকেশ সিগারেটে দুটা লম্বা টান দিয়া বলিল‌, ‘যে চারজন বাবু এখানে তাস খেলতে আসতেন তাঁদের তুমি কয়েকবার দেখেছি–কেমন?

মোহিনীর চক্ষু দু’টি একবার দক্ষিণে-বামে সঞ্চরণ করিল‌, অধরোষ্ঠ ক্ষণকাল বিভক্ত হইয়া রহিল‌, যেন সে হাসিতে গিয়া থামিয়া গেল। তারপর বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, কয়েকবার দেখেছি।’ সে বুঝিয়াছে ব্যোমকেশের প্রশ্ন কোন দিকে যাইতেছে।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওদের মধ্যে কে কেমন লোক তুমি বলতে পার?’

অব্যক্ত হাসি এবার পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। মোহিনী একটু ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল‌, ‘কে কেমন মানুষ তা কি মুখ দেখে বলা যায় বাবু? তবে একজন ছিলেন সবচেয়ে ছেলেমানুষ আর সবচেয়ে ভালোমানুষ। বাকি তিনজন’–সে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, বাকি তিনজন কেমন লোক?’

হাসিমুখে জিভ কাটিয়া মোহিনী বলিল‌, ‘আমি জানি না বাবু।’

মোহিনীর একটা ক্ষমতা আছে‌, সে জানি না’ বলিয়া অনেক কথা জানাইয়া দিতে পারে।

ব্যোমকেশ সিগারেটের দগ্ধাংশ জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিয়া বলিল‌, ‘এঁরা তাস খেলার সময় ছাড়াও অন্য সময়ে আসতেন কি?’

0 Shares