কহেন কবি কালিদাস

মোহিনী কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘একজন আসতেন। কর্তাবাবু সকালবেলা আপিস চলে যাবার পর আসতেন।’

‘নাম জানি না বাবু। কালো মোটা মত চেহারা‌, খুব ছেঁদো কথা বলতে পারেন।’

বরাট অস্ফুটস্বরে বলিলেন‌, ‘অরবিন্দ হালদার।’

ব্যোমকেশ মোহিনীকে বলিল‌, ‘তাহলে তোমার সঙ্গেই তিনি দেখা করতে আসতেন?’

মোহিনী কেবল ঘাড় নাড়িল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কোনো প্রস্তাব করেছিলেন?’

মোহিনীর দৃষ্টি হঠাৎ কঠিন হইয়া উঠিল‌, ‘সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলিল‌, ‘সোনার আংটি দিতে এসেছিলেন‌, সিল্কের শাড়ি দিতে এসেছিলেন।’

‘তুমি নিয়েছিলে?’

না। আমার ইজৎ অত সস্তা নয়।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাহাকে নিবিষ্টচক্ষে নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, আজ এই পর্যন্ত। পরে যদি দরকার হয়। আবার সওয়াল করব। —তুমি উড়িষ্যার মেয়ে‌, কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলতে পারো দেখছি।’

সুন্টু সুব এবার নরম হইল। সে বলিল‌, ‘বাবু্‌, আমি ছেলেবেলা থেকে বাঙালীর বাড়িতে কাজ করেছি।’

ফিরিবার পথে ভাবিতে লাগিলাম‌, মোহিনী-বর্ণিত ছেলেমানুষ এবং ভালোমানুষ লোকটি অবশ্য ফণীশ। অন্য তিনজনের মধ্যে অরবিন্দ হালদার দু’কান-কাঁটা লম্পট। আর বাকি দু’জন? বোধ হয় অতটা বেহায়া নয়‌, কিন্তু মনে লোভ আছে; ডুবিয়া ডুবিয়া জল পান করেন। মোহিনী বলিয়াছিল‌, তাহার ইজ্জৎ অত সস্তা নয়। তাহার ইজ্জতের দাম কত? রূপযৌবনের অনুপাতেই কি ইজ্জতের দাম বাড়ে এবং কমে? কিংবা অন্য কোনও নিরিখ আছে? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই দিতে পারেন।

থানার সামনে বিরাট নামিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওবেলা আবার আসব। সিভিল সার্জন-যিনি আটন্সি করেছেন—তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে।’

বরাট বলিলেন‌, ‘আসবেন। আমি সিভিল সার্জনের সঙ্গে সময় ঠিক করে রাখব। পি এম রিপোর্ট অবশ্য তৈরি আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পি এম রিপোর্টও দেখব।’

বরাট বলিলেন‌, ‘আচ্ছা। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করে রাখব।’

বাড়ি ফিরিলাম তখন বারোটা বাজিয়াছে। কিয়ৎকাল পরে মণীশবাবুরা ফিরিলেন। মণীশবাবু ভ্রূ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিলে সে বলিল‌, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন‌, যা করবার আমি করছি। পুলিসের সঙ্গে দেখা করেছি। একটা ব্যবস্থা হয়েছে‌, পরে আপনাকে সব জানাবো।’

মণীশবাবু সন্তুষ্ট হইয়া স্নান করিতে চলিয়া গেলেন। ফণীশ উৎসুকভাবে আমাদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘তুমিও নিশ্চিন্ত থাকো‌, কাজ খানিকটা এগিয়েছে। বিকেলে আবার বেরুব।’

বেলা তিনটের সময় পিতাপুত্র আবার কাজে বাহির হইলেন। আমরা সুরপতি ঘটকের দপ্তরে গেলাম। সুরপতিবাবু আমাদের অফিস-ঘরে বসাইয়া কয়লাখনি চালানো সম্বন্ধে নানা তথ্য শুনাইতে লাগিলেন। তারপর দ্বারদেশে দুইটি যুবকের আবির্ভাব ঘটিল। খদ্দর-পরা শান্তশিষ্ট চেহারা‌, মুখে বুদ্ধিমত্তার সহিত বিনীত ভাব। সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘এই যে তোমরা এসেছ! গগনবাবু্‌, এদেরই কথা আপনাকে বলেছিলাম। ওরা দুই ভাই‌, নাম বিশ্বনাথ আর জগন্নাথ। ওদের আমি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছি। বয়স কম বটে‌, কিন্তু কাজকর্মে একেবারে পোক্ত।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ বেশ। এখানকার কাজ ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে আপনাদের আপত্তি নেই তো?’

বিশ্বনাথ ও জগন্নাথ মাথা নাড়িয়া জানাইল‌, আপত্তি নাই। সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘ওদের দু’জনকে কিন্তু একসঙ্গে ছাড়তে পারব না‌, তাহলে আমার কাজের ক্ষতি হবে। ওদের মধ্যে একজনকে আপনারা নিন‌, যাকে আপনাদের পছন্দ।’

‘তাই সই বলিয়া ব্যোমকেশ পকেট হইতে নোটবুক বাহির করিয়া দু’জনের নাম-ধাম লিখিয়া লইল‌, বলিল‌, ‘যথাসময় আমি আপনাকে চিঠি দেব।’

বিশ্বনাথ ও জগন্নাথ নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ সুরপতিবাবুকে বলিল‌, দু’জনকেই আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি যাকে দিতে চান তাকেই নেব।’

সুরপতিবাবু খুশি হইয়া বললেন‌, ‘ওরা দুই ভাই সমান কাজের লোক‌, আপনার যাকেই নিন ঠকবেন না।’

চারটে বাজিতে আর দেরি নাই দেখিয়া আমরা উঠিলাম।

বরাট অফিসে ছিলেন‌, বলিলেন‌, ‘সিভিল সার্জন সাড়ে চারটার সময় দেখা করবেন। এই নিন পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট।’

ব্যোমকেশ রিপোর্টে চোখ বুলাইয়া ফেরৎ দিল। তারপর আমরা হাসপাতালের দিকে রওনা হইলাম। সিভিল সার্জন মহাশয়ের অফিস হাসপাতালে।

সিভিল সার্জন বিরাজমোহন ঘোষাল অফিসে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক টানিতেছিলেন। বয়স্থ ব্যক্তি‌, স্কুল গৌরবর্ণ সুদৰ্শন চেহারা‌, আমাদের দেখিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন‌, ‘আপনার আসল নাম আমি জেনে ফেলেছি‌, ব্যোমকেশবাবু। ইন্সপেক্টর বরাট ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করেছিলেন‌, কিন্তু ধাপ্পা টিকল না।’ বলিয়া আবার অট্টহাস্য করিলেন।

ব্যোমকেশ বিনীতভাবে বলিল‌, ‘বে-কায়দায় পড়ে পঞ্চ পাণ্ডবকে ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়েছিল‌, আমি তো সামান্য লোক। একটা গোপনীয় কাজে এখানে এসেছি‌, তাই গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছে।’

‘ভয় নেই‌, আমার পেট থেকে কথা বেরুবে না। বসুন।’

কিছুক্ষণ সাধারণভাবে আলাপ-আলোচনা হাস্য-পরিহাস চলিল। ডাক্তার ঘোষাল আনন্দময় পুরুষ, সারা জীবন মড়া ঘাঁটিয়াও তাঁহার স্বতঃস্ফূর্ত অট্টহাস্য প্রশমিত হয় নাই।

অবশেষে কাজের কথা আরম্ভ হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দারের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট আমি দেখেছি। আপনার মুখে অতিরিক্ত কিছু শুনতে চাই। লোকটি বুড়ো হয়েছিল‌, রোগা-পাটকা ছিল‌, তার দৈহিক শক্তি কি কিছুই অবশিষ্ট ছিল না?’

0 Shares