কহেন কবি কালিদাস

বিরাজবাবু বলিলেন, ‘দৈহিক শক্তি—’

‘মানে–যৌবন। পুরুষের যৌবন অনেক বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে; একশো বছর বয়সে ছেলের বাপ হয়েছে এমন নজিরও পাওয়া যায়। প্রাণহরি পোদ্দারের দেহ-যন্ত্রটা সেদিক দিয়ে কি সক্ষম ছিল?’

বিরাজবাবু আবার অট্টহাস্য করিয়া বলিলেন‌, ‘ও-এই কথা জানতে চান? তা ডাক্তারের কাছে এত লজ্জা কিসের? না‌, প্রাণহরি পোদ্দারের শরীরে রস-কষ কিছু ছিল না‌, একেবারে শুষ্কং’কাষ্ঠং।’ দু’বার গড়গড়ায় টান দিয়া বলিলেন‌, ‘আমি লক্ষ্য করেছি। যারা রাতদিন টাকার ভাবনা ভাবে তাদের ওসব বেশি দিন থাকে না। প্রাণহরি পোদ্দার তো সুদখোর মহাজন ছিল।’

মনে হইল ব্যোমকেশ একটু নিরাশ হইয়াছে। ক্ষণেক ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া সে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ওকথা যাক। এখন মারণাস্ত্রের কথা বলুন। খুলির ওপর ওই একটা চোটু ছাড়া আর কোথাও আঘাতের দাগ ছিল না?’

‘না।’

‘এক আঘাতেই মৃত্যু ঘটেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘অস্ত্রটা কী ধরনের ছিল?’

বিরাজবাবু কিছুক্ষণ গড়গড়া টানিলেন‌, ‘কী রকম অস্ত্র ছিল বলা শক্ত। অস্ত্রটা লম্বা গোছের‌, লম্বা এবং ভারী। কাটারির মত ধারালো নয়‌, আবার পুলিসের রুলের মত ভোঁতাও নয়—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ইলেকট্রিক টর্চ হতে পারে কি?’

‘ইলেকট্রিক টর্চ!’ বিরাজবাবু মাথা নাড়িলেন‌, ‘না‌, তাতে এমন পরিষ্কার কাটা দাগ হবে না। এই ধরুন‌, কাটারির ফলার উল্টো পিঠ দিয়ে‌, অৰ্থাৎ শিরদাঁড়ার দিক দিয়ে যদি সজোরে মাথায় মারা যায় তাহলে ওইভাবে খুলির হাড় ভাঙতে পারে।’

‘রান্নাঘরের হাতা বেড়ি খুস্তি-?’

‘না‌, তার চেয়ে ভারী জিনিস।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘অক্সটাই ভাবিয়ে তুলেছে। যাদের ওপর সন্দেহ তারা দা-কাটারি জাতীয় অস্ত্র নিয়ে খুন করতে গিয়েছিল ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে একেবারে অসম্ভব নয়। আচ্ছা‌, আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আততায়ী সামনের দিক থেকে অস্ত্র চালিয়েছিল‌, না পিছন দিক থেকে?’

বিরাজবাবু তৎক্ষণাৎ বলিলেন‌, ‘সামনের দিক থেকে। কপাল থেকে মাথার মাঝখান পর্যন্ত হাড় ভেঙেছে‌, পিছন দিকের হাড় ভাঙেনি।’

‘পিছন দিক থেকে মারা একেবারেই সম্ভব নয়?’

বিরাজবাবু ভাবিয়া বলিলেন‌, ‘পোদ্দার যদি চেয়ারে বসে থাকত তাহলে ওভাবে মারা সম্ভব। হত‌, দাঁড়িয়ে থাকলে সম্ভব নয়। তবে যদি আততায়ী দশ ফুট লম্বা হয়—

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘দশ ফুট দ্রাঘিমার লোক এখানে থাকলে নজরে পড়ত। আচ্ছা‌, আজ চলি। নমস্কার।’

থানায় ফিরিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘অতঃপর? বাকি তিনজন আসামীকে দর্শন করতে চান?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চাই বৈকি। এখন তাদের বাড়িতে পাওয়া যাবে?’

বরাট বলিলেন‌, ‘না‌, এসময় তারা খেলাধুলো করতে ক্লাবে আসে।’

‘তাহলে এখন থাক। আপনার সঙ্গে ক্লাবে গেলে শিকার ভড়কে যাবে! ভাল কথা‌, পোদ্দারের হিসেবের খাতাটা দিতে পারেন? ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে চাই‌, যদি কিছু পাওয়া যায়।’

‘অফিসেই আছে‌, নিয়ে যান। আর কিছু?’

‘আর-একটা কাজ করলে ভাল হয়। প্ৰাণহরি পোদ্দারের অতীত সম্বন্ধে কিছুই জানা দুই দেড়েক আগে বুড়ে কটকে ছিল। কটকের পুলিস দপ্তর থেকে কিছু খবর পাওয়া যায় না-কি?’

বরাট বলিলেন‌, ‘কটকের পুলিস দপ্তরে খোঁজ নিয়েছিলাম‌, প্রাণহরি পোদ্দারের পুলিস-রেকর্ড নেই। তবে তার সম্বন্ধে সাধারণভাবে যদি জানতে চান‌, আমার একজন চেনা অফিসার কয়েক বছর কটকে আছেন-ইন্সপেক্টর পট্টনায়ক। তাঁকে লিখতে পারি।’

‘তাই করুন। ইন্সপেক্টর পট্টনায়ককে টেলিগ্রাম করে দিন‌, যত শীগগির খবর পাওয়া যায়। আজ উঠলাম‌, কাল সকালেই আবার আসছি।’

নৈশ ভোজনের পর মণীশবাবু উপরে চলিয়া গেলেন‌, আমরা নিজেদের ঘরে আসিলাম। মাথার উপর পাখা খুলিয়া দিয়া আমি শয়নের উপক্রম করিলাম‌, ব্যোমকেশ কিন্তু শুইল না‌, প্রাণহোরর হিসাবের খাতা লইয়া টেবিলের সামনে বসিল। খেরো-বাঁধানো দুভাঁজ করা লম্বা খাতা‌, তাহাতে দেশী পদ্ধতিতে হিসাব লেখা।

ব্যোমকেশ হিসাবের খাতার গোড়া হইতে ধীরে ধীরে পাতা উল্টাইতেছে, আমি খাটের ধারে বসিয়া সিগারেট প্ৰায় শেষ করিয়া আনিয়াছি‌, এমন সময় ফণীশ আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া তাহাকে দেখিল‌, তারপর এক অদ্ভুত কাজ করিল। তাহার সামনে টেবিলের উপর একটি কাচের কাগজ-চাপা গোলক ছিল‌, সে চকিতে তাহা তুলিয়া লইয়া ফণীশের দিকে ছুঁড়িয়া দিল।

ফণীশ টপ করিয়া সেটা ধরিয়া ফেলিল‌, নচেৎ মেঝেয় পড়িয়া চুৰ্ণ হইয়া যাইত। ব্যোমকেশ হাসিয়া ডাকিল‌, ‘এস ফণীশ।’

ফণীশ বিস্মিত হতবুদ্ধি মুখ লইয়া কাছে আসিল‌, ব্যোমকেশ কাচের গোলাটা তাহার হাত হইতে লইয়া বলিল‌, ‘অবাক হয়ে গেছ দেখছি। ও কিছু নয়‌, তোমার রিফ্লেক্স পরীক্ষা করছিলাম। বোসো‌, কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

ফণীশ সামনের চেয়ারে বসিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুমি আজকাল ক্লাবে যাও না?’

ফণীশ বলিল‌, ‘ওই ব্যাপারের পর আর যাইনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাওনি কেন? হঠাৎ যাওয়া বন্ধ করলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’

ফণীশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, কাল থেকে যাব।’

‘আমরাও যাব। অতিথি নিয়ে যেতে বাধা নেই তো?’

‘না। কিন্তু—ক্লাবে আপনার কিছু দরকার আছে কি?’

‘তোমার তিন বন্ধুকে আড়াল থেকে দেখতে চাই।–আচ্ছা‌, একটা কথা বল দেখি‌, সেদিন তোমরা যে প্রাণহরি পোদ্দারকে ঠেঙাতে গিয়েছিলে তোমাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছু ছিল?’

‘অন্ত্র ছিল না। তবে মধুময়বাবুর হাতে একটা লম্বা টর্চ ছিল‌, মুণ্ডুওয়ালা টর্চ। আর মৃগাঙ্কবাবুর হাতে ছিল বেতের ছড়ি।’

0 Shares