কহেন কবি কালিদাস

‘কি রকম ছড়ি? মোটা‌, না লচপচে?

লচপাচে। যাকে swagger came বলে।’

‘হুঁ, তোমার হাতে কিছু ছিল না?’

‘না।’

‘অরবিন্দ হালদারের হাতে?’

‘না।’

‘কাপড়-চোপড়ের মধ্যে লোহার ডাণ্ডা কি ঐরকম কিছু লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল?’

‘না। গরমের সময়‌, সকলের গায়েই হাল্কা ড্রাম-কাপড় ছিল‌, ধুতি আর পাঞ্জাবি। কারুর সঙ্গে ওরকম কিছু থাকলে নজরে পড়ত।’

‘ই—ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া কিছুক্ষণ টানিল‌, শেষে বলিল‌, কোথা দিশা খুঁজে পাই না। তুমি যাও‌, শুয়ে পড়ো গিয়ে। —কবিতা আওড়াতে পারো? বৌমাকে বোলো-নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে।’

ফণীশ লজ্জিত মুখে চলিয়া গেল। আমি শয়ন করিলাম। ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ খাতা দেখিল‌, তারপর আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িল।

অন্ধকারে প্রশ্ন করিলাম‌, ‘খুব তো কবিতা আওড়াচ্ছ‌, আজ সারাদিনে কিছু পেলে?’

উত্তর আসিল‌, ‘তিনটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি। এক-প্রাণহরি পোদ্দারকে যিনি খুন করেছেন তাঁর টাকার লোভ নেই; দুই-তিনি সব্যসাচী; তিন-মোহিনীর মত মেয়ের জন্য যে-কেউ খুন করতে পারে।–এবার ঘুমিয়ে পড়।’

সকালে ঘুম ভাঙিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ আবার হিসেবের খাতা লইয়া বসিয়াছে।

তারপর যথাসময়ে প্রাতরাশ গ্রহণ করিয়া বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ হিসাবের খাতটি সঙ্গে লইল।

থানায় পৌঁছিলে ইন্সপেক্টর বিরাট হাসিয়া বলিলেন‌, ‘এরই মধ্যে হিসেবের খাতা শেষ করে ফেললেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ খাতায় মাত্র দেড় বছরের হিসেব আছে‌, অর্থাৎ এখানে আসার পর প্রাণহরি নতুন খাতা আরম্ভ করেছিল।’

বরাট জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কিছু পেলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুনের ওপর আলোকপাত করে এমন কিছু পাইনি। কিন্তু একটা সামান্য বিষয়ে খাটুকা লেগেছে।’

‘কী বিষয়?’

‘একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে প্ৰাণহারির ব্যবস্থা ছিল‌, সে রোজ তাকে ট্যাক্সিতে বাড়ি থেকে নিয়ে আসত‌, আবার বাড়ি পৌঁছে দিত। মাসিক ভাড়া দেবার ব্যবস্থা ছিল নিশ্চয়। কিন্তু হিসেবের খাতায় দেখছি ঠিক উল্টো। এই দেখুন খাতা।’ ব্যোমকেশ খাতা খুলিয়া দেখাইল। খাতার প্রতি পৃষ্ঠায় পাশাপাশি জমা ও খরচের স্তম্ভ। খরচের স্তম্ভে এক পয়সা দুই পয়সার খরচ পর্যন্ত লেখা আছে‌, কিন্তু জমার স্তম্ভ। অধিকাংশ দিনই শূন্য। মাঝে মাঝে কোনও খাতক সুদ জমা দিয়াছে তাহার উল্লেখ আছে। ব্যোমকেশ আঙুল দিয়া দেখাইল‌, ‘এই দেখুন‌, ৩রা মাঘ জমার কলমে লেখা আছে‌, ট্যাক্সি-ড্রাইভার ৩৫ টাকা। এমনি প্রত্যেক মাসেই আছে। কিন্তু খরচের কলমে ট্যাক্সি বাবদ কোনো খরচের উল্লেখ নেই।’

হয়তো ভুল করে খরচটা জমার কলমে লেখা হয়েছিল।’

‘প্রত্যেক মাসেই কি ভুল হবে?

‘হুঁ। আপনার কি মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না। খাতায় জুয়া খেলার লাভ-লোকসানের হিসেবও নেই। একটু রহস্যময় মনে হয় না কি?’

‘তা মনে হয় বৈকি। এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে?’

ব্যোমকেশ ভাবিয়া বলিল‌, ‘প্ৰাণহরি যার ট্যাক্সিতে যাতায়াত করত তাকে পেলে সওয়াল জবাব করা যায়। তাকে চেনেন নাকি?’

বরাট বলিলেন‌, ‘না‌, তার খোঁজ করা দরকার মনে হয়নি। এক কাজ করা যাক‌, ভুবন দাসকে ডেকে পাঠাই‌, সে নিশ্চয় সন্ধান দিতে পারবে।’

‘ভুবন দাস?’ −

‘সো-রাত্রে ওদের চারজনকে যে ট্যাক্সি-ড্রাইভার প্রাণহারির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তার নাম ভুবনেশ্বর দাস।’

‘ও-তাকে কি পাওয়া যাবে?

‘কাছেই ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড। আমি ডেকে পাঠাচ্ছি।’

পনেরো মিনিট পরে ভুবনেশ্বর দাস আসিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল। দোহারা চেহারা‌, খাকি প্যান্টুলুন ও শার্ট‌, মাথায় গার্ডসাহেবের মত টুপি। বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্ৰিশ‌, চোখ দু’টি অরুণাভ‌, মুখ গভীর। সন্দেহ হইল লোকটি নেশাভাঙা করিয়া থাকে।

বরাট ঘাড় নাড়িয়া ব্যোমকেশকে ইঙ্গিত করিলেন‌, ব্যোমকেশ ভুবন দাসকে একবার আগাপাস্তলা দেখিয়া লইয়া প্রশ্ন আরম্ভ করিল‌, ‘তোমার নাম ভুবন দাস। মিলিটারিতে ছিলে?’

ভুবন দাস বলিল‌, ‘আজ্ঞে।’

‘সিপাহী ছিলে?

‘আত্তে না‌, ট্রাক-ড্রাইভার।’

‘ট্যাক্সি চালাচ্ছে কত দিন?’

‘তিন-চার বছর।’

‘তিন-চার বছর এখানেই ট্যাক্সি চালোচ্ছ?

‘আজ্ঞে না‌, এখানে বছর দেড়েক আছি‌, তার আগে কলকাতায় ছিলাম।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘মেদিনীপুর জেলা‌, ভগবানপুর গ্রাম।’

‘তুমি সেদিন চারজনকে নিয়ে প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়িতে গিয়েছিলে?’

‘আজ্ঞে বাড়িতে নয়‌, বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে।’

‘বেশ। তোমার ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেছিল?’

ভুবন দাস একটু নীরব থাকিয়া বলিল‌, ‘বলেছিল। আমি সব কথায় কান করিনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, কিছু মনে আছে?’

ভুবন দাস আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘বোধ হয় কোনো মেয়েলোকের সম্বন্ধে কথা হচ্ছিল। চাপা গলায় কথা হচ্ছিল‌, ভাল শুনতে পাইনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা যাক। বল দেখি‌, তোমার চারজন যাত্রীর কারুর হাতে কোনো অস্ত্র ছিল?’

‘একজনের হাতে ছড়ি ছিল।’

‘আর কারুর হাতে কিছু ছিল না?’

‘লক্ষ্য করিনি।’

‘তুমি নেশা করা?’

‘আজ্ঞে না বলিয়া ভুবন দাস ইন্সপেক্টর বরাটের দিকে বক্র কটাক্ষপাত করিল।

‘শহরে তোমার বাসা কোথায়?’

‘বাসা নেই। রাত্তিরে গাড়িতেই শুয়ে থাকি।’

‘গাড়ি তোমার নিজের?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘শহরের অন্য ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে তোমার নিশ্চয় জানাশোনা আছে।’

‘জানাশোনা আছে‌, বেশি মেলামেশা নেই।’

বলতে পারো‌, কার ট্যাক্সিতে চড়ে প্ৰাণহরি পোদ্দার শহরে যাওয়া-আসা করতেন?

মনে হইল। ভুবন দাসের রক্তাভ চোখে একটু কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়া গেল। সে কিন্তু গম্ভীর স্বরেই বলিল‌, ‘আজ্ঞে স্যার‌, আমার ট্যাক্সিতে।’

0 Shares