কহেন কবি কালিদাস

আমরা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। তারপর বিরাট কড়া সুরে বলিলেন‌, ‘একথা আগে আমাকে বলনি কেন?’

ভুবন বলিল‌, ‘আপনি তো সুধোননি স্যার।’

ব্যোমকেশ হাসি চাপিয়া পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিল। ট্যাক্সি-ড্রাইভার সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা খুব বিস্তীর্ণ নয়, কিন্তু লক্ষ্য করিয়াছি তাহারা অতিশয় স্বল্পভাষী জীব, অকারণে বাক্য ব্যয় করে না। অবশ্য ভাড়া লইয়া ঝগড়া বাধিলে স্বতন্ত্র কথা।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুমি তাহলে প্ৰাণহরি পোদ্দারকে আগে থাকতেই চিনতে?

ভুবন বলিল‌, ‘আজ্ঞে।’

‘তিনি কি রকম লোক ছিলেন?’

‘ভাল লোক ছিলেন স্যার‌, কখনো ভাড়ার টাকা ফেলে রাখতেন না।’ ভুবনের কাছে ইহাই সাধুতার চরম নিদর্শন।

‘রোজ নগদ ভাড়া দিতেন?’

‘আজ্ঞে না‌, মাস-মাইনের ব্যবস্থা ছিল।’

‘কত টাকা মাস-মাইনে?’

‘পঁয়ত্ৰিশ টাকা।’

বরাটের সহিত ব্যোমকেশ মুখ-তাকাত কি করিল‌, তারপর ভুবনকে বলিল‌, ‘প্রাণহরি পোদ্দারের সম্বন্ধে তুমি কী জানো সব আমায় বল।’

ভুবন বলিল‌, ‘বেশি কিছু জানি না। স্যার। শহরে ওঁর একটা অফিস আছে। বছরখানেক আগে উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে মাস-মাইনেতে ট্যাক্সি ভাড়া করার কথা তোলেন‌, আমি রাজী হই। তারপর থেকে আমি ওঁকে সকালে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম‌, আবার বিকেলবেলা পৌঁছে দিতাম। বাংলা মাসের গোড়ার দিকে উনি আমাকে অফিসে ডেকে ভাড়া চুকিয়ে দিতেন। এর বেশি ওঁর বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

‘তুমি মাত্র পঁয়ত্ৰিশ টাকা মাস-মাইনেতে রাজী হয়েছিলে? লাভ থাকতো?’

‘সামান্য লাভ থাকতো। বাঁধা ভাড়াটে তাই রাজী হয়েছিলাম।’

ব্যোমকেশ খানিক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর প্রশ্ন করিল‌, ‘অন্য কোনো ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে প্রাণহারিবাবুর কারবার ছিল কিনা জানো?’

ভুবন বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি জানি না।’

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, তুমি এখন যাও। যদি প্রাণহরি সম্বন্ধে কোনো কথা মনে পড়ে দারোগাবাবুকে জানিও।’

‘আজ্ঞে।’ ভুবন দাস স্যালুট করিয়া চলিয়া গেল।

তিনজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসিয়া রহিলাম। তারপর বরাট বলিলেন‌, ‘কিছুই তো পাওয়া গেল না। হিসেবের খাতায় হয়তো ভুল করেই খরচের জায়গায় জমা লেখা হয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিংবা সাংকেতিক জমা-খরচ।’

ভ্রূ তুলিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘সাংকেতিক জমা-খরচ কি রকম?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মনে করুন প্রাণহরি পোদ্দার কাউকে ব্ল্যাকমেলা করছিল। ভুকন দাস তাকে যত ভাল লোকই মনে করুক আমরা জানি সে প্যাঁচালো লোক ছিল। মনে করুন। সে মাসিক সত্তর টাকা হিসেবে ব্ল্যাকমেল আদায় করছে‌, কিন্তু সে-টাকা তো সে হিসেবের খাতায় দেখাতে পারে না। এদিকে ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে দিতে হয় মাসে পঁয়ত্ৰিশ টাকা। প্ৰাণহারি খাতায় সাংকেতিক হিসেব লিখল‌, সত্তর টাকা থেকে পঁয়ত্ৰিশ টাকা বাদ দিয়ে পঁয়ত্ৰিশ টাকা জমা করল। যাকে ব্ল্যাকমেল করছে তার নাম লিখতে পারে না‌, তাই ট্যাক্সি-ড্রাইভারের নাম লিখল। বুঝেছেন?’

বরাট বলিলেন‌, ‘বুঝেছি। অসম্ভব নয়। প্রাণহারির মনটা খুবই প্যাঁচালো ছিল‌, কিন্তু আপনার মন আরো প্যাঁচালো।’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘আচ্ছা‌, আজ উঠি। প্রাণহরি কাকে ব্ল্যাকমেল করছিল জানতে পারলে হয়তো খুনের একটা সূত্র পাওয়া যেত। কিন্তু ওর দলিল-পত্রে ওরকম কিছু বোধহয় পাওয়া যায়নি?

না। যে দু’চারটে কাগজপত্র পাওয়া গেছে তাতে বে-আইনী কার্যকলাপের কোনো ইঙ্গিত নেই।–আজ ওবেলা আসছেন নাকি?’

লোমকেশ বলি‌, ওবেলা আপনাকে আর বিরক্ত করব না। ফণীশের সঙ্গে কয়লা ক্লাবে যাচ্ছি।

কয়লা ক্লাবের বাড়িটি সুবিস্তৃত ভূমিখণ্ড দ্বারা পারিবেষ্টিত। সামনে বাগান ও মোটর রাখিবার পার্কিং লন‌, দুই পাশে ব্যাডমিণ্টন টেনিস প্রভৃতি খেলিবার স্থান। বাড়িটি একতলা হইলেও অনেকগুলি বড় বড় ঘর আছে। মাঝখানের হলঘরে বিলিয়ার্ড খেলার টেবিল; অন্য ঘরের কোনোটিতে পিংপং টেবিল‌, কোনোটিতে চার পাঁচটা তাস খেলার টেবিল ও চেয়ার। আবার একটা ঘরের মেঝোয় ফরাস পাতা‌, এখানে দাবা ও পাশা খেলার আসর। বাড়ির পিছন ভাগে দুইটি অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর; একটিতে ম্যানেজারের অফিস‌, অন্যটিতে পানাহারের ব্যবস্থা‌, টুকিটাকি খাবার‌, নরম ও গরম নানা জাতীয় পানীয় এখানে সভ্যদের জন্য প্রস্তুত থাকে।

আমরা যখন ক্লাবে গিয়া পৌঁছিলাম তখনও যথেষ্ট দিনের আলো আছে। অনেক সভ্য সমবেত হইয়াছেন। বাহিরে টেনিস কোর্টে খেলা চলিতেছে; চারজন খেলিতেছে‌, বাকি সকলে কোর্টের পাশে চেয়ার পাতিয়া বসিয়া খেলা দেখিতেছেন। ফণীশ আমাদের সেই দিকে লইয়া চলিল।

কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া খেলা দেখিবার পর ব্যোমকেশ ফণীশের কানে কানে বলিল‌, ‘তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ আছে নাকি?’

ফণীশ বলিল‌, ‘ঐ যে খেলছেন‌, তোয়ালের নীল গেঞ্জি আর শাদা প্যান্টুলুন‌, উনি মৃগেন মৌলিক।’

একটু রোগা ধরনের শরীর হইলেও মৃগেন মৌলিকের চেহারা বেশ খেলোয়াড়ের মত। খেলার ভঙ্গীতে একটু চালিয়াতি ভাব আছে‌, কিন্তু সে ভালই টেনিস খেলে। ব্যাকহ্যান্ড বেশ জোরালো; নেটের খেলাও ভাল।

ব্যোমকেশ খেলা দেখিতে দেখিতে বলিল‌, ‘বাকি দু’জন। এখানে নেই?’

ফণীশ বলিল‌, ‘না। চলুন‌, ভেতরে যাওয়া যাক।’

এই সময় পিছন হইতে কণ্ঠস্বর শোনা গেল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু-থুড়ি-গগনবাবু যে!’

ফিরিয়া দেখিলাম‌, আমাদের পূর্ব-পরিচিত গোবিন্দ হালদার ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া মধুর গেরিলা-হাস্য হাসিতেছেন।

ব্যোমকেশ কিন্তু হাসিল না‌, স্থির-দৃষ্টিতে গোবিন্দবাবুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আসল নামটা জানতে পেরেছেন দেখছি। কি করে জানলেন?’

0 Shares