গোবিন্দবাবু বলিলেন, ‘প্রথম দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর দুই আর দুয়ে মিলিয়ে দেখলাম ঠিক মিলে গেল। গগন-ব্যোমকেশ, সুজিত—অজিত।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাদের নামকরণ ভাল হয়নি, কাঁচা কাজ হয়েছিল। কিন্তু আসল নামের বহুল প্রচার কি বাঞ্ছনীয়?’
গোবিন্দবাবু বলিলেন, ‘আমি প্রচার করছি না। নামটা আলটপকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। যা হোক, আমাদের ক্লাবে পদার্পণ করেছেন খুবই আনন্দের কথা। উদ্দেশ্য কিছু আছে নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার কি মনে হয়?’
গোবিন্দবাবুর মন্থর চক্ষু দু’টি একবার ফণীশের দিকে গিয়া আবার ব্যোমকেশের মুখে ফিরিয়া আসিল, ‘আপনি কাজের লোক, অকারণে আমোদ করে বেড়াবেন বিশ্বাস হয় না। কাজেই এসেছেন। কিন্তু কোন কাজ? কয়লাখনির রহস্য উদঘাটন?
ব্যোমকেশ আবার বলিল, ‘আপনার কি মনে হয়?’
গোবিন্দবাবুর চক্ষু দু’টি কুঞ্চিত হইয়া ক্রমে দুইটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হইল, ‘তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছি। দেখুন, আপনি স্থশিয়ার লোক, তবু সাবধান করে দিচ্ছি। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করবেন না।’ তাঁহার কুঞ্চিত চক্ষুযুগল একবার ফণীশের দিকে সঞ্চারিত হইল, তারপর তিনি টেনিস কোর্টের কিনারায় গিয়া চেয়ারে বসিলেন।
ফণীশের মুখে শঙ্কার ছায়া পড়িয়ছিল, সে স্বলিত স্বরে বলিল, ‘গোবিন্দবাবু অরবিন্দবাবুর বড় ভাই। উনি যদি বাবাকে বলে দেন—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভয় নেই, গোবিন্দবাবু কাউকে কিছু বলবেন না। উনি নিজের দুৰ্বত্ত ছোট ভাইটিকে ভালবাসেন।–চল, ভিতরে যাই।’
বাড়ির সামনের বারান্দায় একটি টেবিলে দৈনিক সংবাদপত্র সাপ্তাহিক প্রভৃতি সাজানো রহিয়াছে, আমরা সেইখানে গিয়া বসিলাম। ফণীশ একজন তকমাধারী ভৃত্যকে ডাকিয়া তিন গেলাস ঘোলের সরবৎ হুকুম করিল।
বরফ-শীতল সরবৎ চাখিতে চাখিতে দেখিতেছি, ঘোর ঘোর হইয়া আসিতেছে। বাহিরে টেনিস খেলা শেষ হইল। সভ্যেরা ভিতরে আসিতেছেন, নানা কথার ছিন্নাংশ কানে আসিতেছে। বাড়ির ভিতরে ঘরে ঘরে উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলিয়া উঠিয়াছে। টেবিল-টেনিসের ঘর হইতে খটখট শব্দ আসিতেছে। হঠাৎ কোনও সভ্য উচ্চকণ্ঠে হাঁকিতেছেন–এই বেয়ারা!
সম্ভ্রান্ত সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার একটি চলমান চিত্র।
সরবৎ নিঃশেষ হইলে আমরা সিগারেট ধরাইয়া বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম। মাঝের হলঘরে দুইজন নিঃশব্দ খেলোয়াড় নিরুদ্বেগ মন্থরতায় বিলিয়ার্ড খেলিতেছেন; প্রকাণ্ড টেবিলের উপর তিনটা বল তিনটি শিশুর মত লুকোচুরি খেলিতেছে। —এখানে আমাদের দ্রষ্টব্য কেহ নাই। এখান হইতে টেবিল-টেনিসের ঘরে গেলাম; দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া দেখিলাম, হাফ-ভলির খেলা চলিতেছে; খাটাখাট শব্দে বল টেবিলের এপার হইতে ওপারে ছুটোছুটি করিতেছে; ব্যস্ত-সমস্ত একটি শুভ্র বুদ্বুদ। এ ঘরেও আমাদের দর্শনীয় কেহ নাই।
ফরাস-পাত ঘর হইতে মাঝে মাঝে হাল্লার আওয়াজ আসিতেছিল। সেখানে পাশা বসিয়াছে, চারজন খেলোয়াড় ছক ঘিরিয়া চতুষ্কোণভাবে বসিয়াছেন। একজন দুহাতে হাড় ঘষিতে ঘষিতে আদূরে সুরে পাশাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, ‘পাশা! বারো-পাঞ্জা-সতেরো! একবারটি বারো-পাঞ্জা সতেরো দেখাও! এমন মার মারব, পেটের ছানা বেরিয়ে যাবে।’ তিনি পাশা ফেলিলেন। বিরুদ্ধ পক্ষ হইতে বিপুল হর্ষধ্বনি উঠিল—‘তিনি কড়া! তিনি কড়া।’
আমরা দ্বারের নিকট হইতে অপসৃত হইয়া তাসের ঘরে উপনীত হইলাম।
তাসের ঘরে সব টেবিল এখনও ভর্তি হয় নাই; কোনও টেবিলে একজন বসিয়া পেশেন্স খেলিতেছেন, কোনও টেবিলে তিনজন খেলোয়াড় চতুর্থ ব্যক্তির অভাবে গলা-কাটা খেলা খেলিয়া সময় কাটাইতেছেন। একটি টেবিলে চতুরঙ্গ খেলা বসিয়াছে; চারজন খেলোয়াড় গভীর মনঃসংযোগে নিজ নিজ তাস দেখিতেছেন। একজন বলিলেন, ‘থ্রি হার্টস।’ কন্ট্র্যাক্ট খেলা।
ফণীশ ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘যিনি ডাক দিলেন মধুময় সুর, আর তাঁর পার্টনার অরবিন্দ হালদার।’
ব্যোমকেশ টেবিলের কাছে গেল না, দূর হইতে সেইদিক পানে চাহিয়া রহিল। অরবিন্দ হালদার যে গোবিন্দ হালদারের ছোট ভাই, তাহা পরিচয় না দিলেও বোঝা যায়। সেই গেরিলাগঞ্জন রূপ, কেবল বয়স কম। মধুময় সুর ফিট্ফট শৌখিন লোক, চেহারায় ব্যক্তিত্বের অভাব গিলে-করা পাঞ্জাবি ও হীরার বোতাম প্রভৃতি দিয়া পূর্ণ করিবার চেষ্টা দেখা যায়।
খেলা আরম্ভ হইয়াছে, ডামি হইয়াছেন বিপক্ষ দলের একজন। ফ্ল্যামের খেলা, কাহারও অন্য দিকে মন নাই।
পাঁচ মিনিট খেলা দেখিয়া ব্যোমকেশ ইশারা করিল, আমরা বাহিরে আসিলাম। সে সম্ভাব্য আসামীদের দেখিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই, শুষ্ক স্বরে বলিল, ‘যা দেখবার দেখা হয়েছে, চল এবার বাড়ি ফেরা যাক।’
মোটরে বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী দেখলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তিনটে মানুষকে দেখলাম, তাদের পারিবেশ দেখলাম, হাত-পা নাড়া দেখলাম।–ফণীশ, কাল সকালে আমরা ওদের বাড়িতে যাব। আলাপ-পরিচয় করা দরকার। আজ যা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কিছু পাব আশা করি না, তবু—’
‘আজ কিছু পেয়েছ তাহলে?’
‘পেয়েছি। যদিও সেটা নেতিবাচক।’
পরদিন সকালে ফণীশ বাপের সঙ্গে কয়লাখনিতে গেল না, মণীশবাবু একাই গেলেন। ফণীশ আমাদের গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল। গাড়িতে স্টার্ট দিয়া বলিল, ‘আগে কোথায় যাবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার কারুর প্রতি পক্ষপাত নেই, যার বাড়ি কাছে তার বাড়িতে আগে চল।’
‘তাহলে মৃগেনবাবুর বাড়িতে চলুন।’