মৃগেন মৌলিকের বাড়িটি অতিশয় সুশ্রী, গৃহস্বামীর শৌখিন রুচির পরিচয় দিতেছে। আমাদের মোটর বাগান পার হইয়া গাড়ি-বারান্দায় উপস্থিত হইলে দেখিলাম মৃগেন মৌলিক বাড়ির সম্মুখে ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছে, তাহার পরিধানে চিলা পায়জামা ও সিঙ্কের ড্রেসিং গাউন। আমরা গাড়ি হইতে নামিলে সে কাগজ মুড়িয়া আমাদের পানে চোখ তুলিল। স্বাগত সম্ভাষণের হাসি তাহার মুখে ফুটিল না, বরঞ্চ মুখ অন্ধকার হইল। আমরা তাহার নিকটবর্তী হইলে সে রূঢ় স্বরে বলিল, ‘কি চাই?’
আমরা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। ফণীশ বলিল, ‘মৃগেনবাবু্, এঁরা আমার বাবার বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছেন–’
ফণীশের প্রতি তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া মৃগেন বলিল, ‘জানি। ব্যোমকেশ বক্সী কার নাম?’
ফণীশ থাতমত খাইয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি ব্যোমকেশ বক্সী। আপনার সঙ্গে দুটো কথা ছিল।’
মৃগেন মুখ বিকৃত করিয়া অসীম অবজ্ঞার স্বরে বলিল, ‘এখানে কিছু হবে না, আপনারা যেতে পারেন।’ বলিয়া নিজেই কাগজখানা বগলে লইয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল।
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। ফণীশের মুখ অপমানে সিন্দূরবর্ণ ধারণ করিয়াছে, ব্যোমকেশের অধরে লাঞ্ছিত হাসি। সে বলিল, ‘গোবিন্দ হালদার দেখছি আসামীদের সতর্ক করে দিয়েছেন।’
ফণীশ বলিল, চলুন, বাড়ি ফিরে যাই।’ ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, যখন বেরিয়েছি তখন কাজ সেরে বাড়ি ফিরব। ফণীশ, তুমি লজ্জা পেও না। সত্যান্বেষণ যাদের কাজ তাদের লজ্জা, ঘৃণা, ভয় ত্যাগ করতে হয়; চল, এবার মধুময় সুরের বাড়িতে।’
মোটরে যাইতে যাইতে আমি বলিলাম, কিন্তু কেন? এরকম ব্যবহারের মানে কি? মৃগেন মৌলিক যদি নির্দোষ হয় তাহলে তার ভয় কিসের?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওদের ধারণা হয়েছে। আমি ফণীশের দলের লোক, ফণীশকে বাঁচিয়ে ওদের ফাঁসিয়ে দিতে চাই।’
মধুময় সুরের বাড়িটি সেকেলে ধরনের, বাগানের কোনও শোভা নাই। বাড়ির সদর বারান্দায় মধুময় সুর গামছা পরিয়া মাদুরের উপর শুইয়া ছিল এবং একটা মুস্কো জোয়ান চাকর তৈল দিয়া তাহার দেহ ডলাই-মলাই করিতেছিল। মধুময়ের শরীর খুব মাংসল নয়, কিন্তু একটি নিরেট গোছের ক্ষুদ্র ভূড়ি আছে! আমাদের দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল।
ফণীশ ক্ষীণ কুষ্ঠিত স্বরে আরম্ভ করিল, ‘মধুময়বাবু্, মাফ করবেন, এটা আপনার স্নানের সময়—’
মধুময় তাহার কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া আমাদের দিকে কয়েকবার চক্ষু মিটমিটি করিল, তারপর পাখি-পড়া সুরে বলিল, ‘আপনারা আমার কাছে কেন এসেছেন, আমি প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানি না। যদি কেউ বলে থাকে আমি তার মৃত্যুর রাত্রে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তবে তা মিথ্যে কথা। অন্য কেউ গিয়েছিল। কিনা আমি জানি না, আমি যাইনি।’ বলিয়া মধুময় সুর আবার শয়নের উপক্রম করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ট্যাক্সি-ড্রাইভার কিন্তু আপনাকে সনাক্ত করেছে।’
মধুময় বলিল, ট্যাক্সি-ড্রাইভার মিথ্যাবাদী। —আসুন, নমস্কার।’
ব্যোমকেশ চন্টু করিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আপনার একটা টর্চ আছে?’
মধুময় বলিল, ‘আমার পাঁচটা টাৰ্চ আছে। আসুন, নমস্কার।’
মধুময় শয়ন করিল, ভূত্য আবার তেল-মৰ্দন আরম্ভ করিল। আমরা চলিয়া আসিলাম।
অরবিন্দ হালদারের বাড়ির দিকে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা আসব মধুময় জানতো, আমাদের কী বলবে মুখস্থ করে রেখেছিল। যাই বল, মৃগেন মৌলিকের চেয়ে মধুময় সুর ভদ্র। কেমন মিষ্টি সুরে বলল-আসুন, নমস্কার। নিমচাঁদ দত্তের ভাষায়-ছেলেটি বে-তরিবৎ নয়।’
অরবিন্দ হালদার ও গোবিন্দ হালদার একই বাড়িতে বাস করেন, কিন্তু মহল আলাদা। অরবিন্দ নিজের বৈঠকখানায় ফরাস-ঢাকা তক্তপোশের উপর মোটা তাকিয়া মাথায় দিয়া শুইয়া সিগারেট টানিতেছিল, আমাদের দেখিয়া কনুই-এ ভর দিয়া উঠিল। তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ, কালো মুখে অক্ষৌরিত দাড়ির কর্কশতা। সে আমাদের পর্যায়ক্রমে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল, ‘এস ফণীশ।’
ফণীশ পাংশুমুখে বলিল, ‘এঁরা—’
অরবিন্দ বলিল, ‘জানি। বসুন আপনারা।’ বলিয়া সিগারেটের কোটা আগাইয়া দিল।
শিষ্টতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তাই একটু ব্থতমীত হইলাম। ব্যোমকেশ তক্তপোশের কিনারায় বসিল, আমরাও বসিলাম। অরবিন্দ সহজ সুরে বলিল, ‘কাল রাত্রে মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এখনো খোঁয়ারি ভাঙেনি।–ওরে গদাধর।’
একটি ভূত্য কাচের গেলাসে পানীয় আনিয়া দিল, অরবিন্দ এক চুমুকে তাহা নিঃশেষ করিয়া গেলাস ফেরৎ দিয়া বলিল, ‘আপনাদের জন্যে কী আনাব বলুন। চা? সরবৎ? বীয়ার?
ব্যোমকেশ বিনীত কণ্ঠে বলিল, ‘ধন্যবাদ। ওসব কিছু চাই না, অরবিন্দবাবু; আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলবার সুযোগ পেলেই কৃতাৰ্থ হয়ে যাব।’
অরবিন্দ বলিল, ‘বিলক্ষণ! কি বলকেন বলুন। তবে একটা কথা গোড়ায় জানিয়ে রাখি। সুন্টু স্থাপনাকে কী বলেছে জানি না, কিন্তু প্রশস্ত্রর পোস্কারের মৃত্যুর রাত্রে আমি তার বাড়িতে যাইনি।’
ব্যোমকেশ একটু নীরব থাকিয়া বলিল, ‘অরবিন্দবাবু্, আমার কোনো কু-মতলব নেই। নির্দোষ বুক্সমুলা মামলায় ফাঁসালে আমার কাজ নয়, আমি সত্যান্বেষী। অবশ্য আপনি যদি অপরাধী হন–’
অরবিন্দ বলিল, ‘আমি নিরপরাধ। প্রাণহোরর মৃত্যুর রাত্রে আমি তার বাড়ির ত্ৰিসীমানায় যাইনি। এই কথাটা বুঝে নিয়ে যা প্রশ্ন করবেন করুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ, ও প্রসঙ্গ না হয় বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু প্ৰাণহারির মৃত্যুর আগে আপনি কয়েকবার তার বাড়িতে গিয়েছিলেন।’