কহেন কবি কালিদাস

অরবিন্দ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আমরা চারজনে জুয়া খেলতে যেতাম।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জুয়া খেলার সময় ছাড়াও আপনি কয়েকবার একলা তার বাড়িতে গিয়েছিলেন।’

অরবিন্দের মুখে একটা বিশ্রী লুচ্চামির হাসি খেলিয়া গেল‌, সে বলিল‌, ‘তা গিয়েছিলাম।’

‘কি জন্যে গিয়েছিলেন?’

নির্লজভাবে দন্ত বিকাশ করিয়া অরবিন্দ বলিল‌, ‘মোহিনীকে দেখতে। তার সঙ্গে ভাব জমাতে।’

ব্যোমকেশ বাঁকা সুরে বলিল‌, ‘কিন্তু সুবিধে হল না?’

অরবিন্দের মুখের হাসি মিলাইয়া গেল‌, সে বড় বড় চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিল‌, ‘সুবিধে হল না—তার মানে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মানে বুঝতেই পারছেন। আপনি কি বলতে চান যে-?’

অরবিন্দ হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল‌, তারপর হাসি থামাইয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি মস্ত একজন ডিটেকটিভ হতে পারেন। কিন্তু দুনিয়াদারির কিছুই জানেন না। মোহিনী তো তুচ্ছ মেয়েমানুষ‌, দাসীবাদী। টাকা ফেললে এমন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কত টাকা ফেলেছিলেন?’

অরবিন্দ দুই আঙুল তুলিয়া বলিল‌, ‘দু’হাজার টাকা।’

‘মোহিনীকে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন? দাসীবাদীর পক্ষে দাম একটু বেশি নয় কি?’

‘মোহিনীকে দিইনি। মোহিনীর দালালকে দিয়েছিলাম। প্ৰাণহরি পোদ্দারকে।’ অরবিন্দের কথাগুলো বিষমাখানে।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ও কথা যাক। প্রাণহরি পোদ্দার লোকটা কেমন ছিল?’

অরবিন্দ নীরসকণ্ঠে বলিল‌, ‘চামার ছিল‌, অর্থ-পিশাচ ছিল। সাধারণ মানুষ যেমন হয় তেমনি ছিল।’

সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে অরবিন্দের ধারণা খুব উচ্চ নয়। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জুয়াতে প্রাণহারি পোদ্দার আপনাদের অনেক টাকা ঠকিয়েছিল?’

অরবিন্দ তাচ্ছিল্যভরে বলিল‌, ‘সে জিতেছিল আমরা হেরেছিলাম। ঠকিয়েছিল কিনা বলতে পারি না।’

‘তবে তাকে ঠেঙাতে গিয়েছিলেন কেন?’

অরবিন্দ উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়া থামিয়া গেল‌, ব্যোমকেশকে একবার ভালভাবে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘কে বললে ঠেঙাতে গিয়েছিলাম? যারা গিয়েছিল তারা নিজের কথা বলুক‌, আমি কাউকে ঠেঙাতে যাইনি।’

আমি ফণীশের দিকে অপাঙ্গ-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। সে হেঁট মুখে শুনিতেছিল‌, একবার চোখ তুলিয়া অরবিন্দের পানে চাহিল‌, তারপর আবার মাথা হেঁট করিল।

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘আপনি যেটুকু বললেন‌, তাতেও গরমিল আছে‌, মোহিনীর কথার সঙ্গে আপনার কথা মিলছে না। হয়তো আপনার কথাই সত্যি। আচ্ছা‌, নমস্কার। আপনার দাদাকে বলবেন‌, পুলিসকে ঘুষ দিতে যাওয়া নিরাপদ নয়‌, তাতে সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। সব পুলিস অফিসার ঘুষখোর নয়।’

অতঃপর তিনদিন আমরা প্রায় নিষ্কর্মার মত কাটাইয়া দিলাম‌, প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যুরহস্য ত্ৰিশঙ্কুর মত শূন্যে বুলিয়া রহিল। নূতন তথ্য আর কিছু পাওয়া যায় নাই‌, পূর্বে সামান্য যেটুকু পাওয়া গিয়াছিল তাঁহাই সম্বল। কটক হইতে ইন্সপেক্টর বরাটের বন্ধু পট্টনায়ক প্রাণহারির অতীত সম্বন্ধে যে পত্র দিয়াছিলেন তাহার দ্বারাও খুনের উপর আলোকপাত হয় নাই। প্রাণহরি পোদ্দার পেশাদার জুয়াড়ী ছিল‌, কিন্তু কোনও দিন পুলিসের হাতে পড়ে নাই। সে বছর-দুই কটকে ছিল‌, কোথা হইতে কটকে আসিয়াছিল তাহা জানা যায় না। তাহার পোষ্য কেহ ছিল না‌, কাজকর্মও ছিল না। নিজের বাড়িতে কয়েকজন বড়মানুষের অবচীিন পুত্রকে লইয়া জুয়ার আডডা বসাইত। ক্রমে অবচীিনেরা বুঝিল প্ৰাণহোর জুয়াচুরি করিয়া তাঁহাদের রুধির শোষণ করিতেছে‌, তখন তাহারা প্রাণহারিকে উত্তম-মধ্যম দিবার পরামর্শ করিল। কিন্তু পরামর্শ কর্যে পরিণত করিবার পূর্বেই একদিন প্রাণহরি পোদ্দার নিরুদ্দেশ্য হইল। তাহার বাড়িতে একটি যুবতী দাসী কাজ করিত‌, সেও লোপাট হইল। অনুমান হয় বৃদ্ধ প্রাণহারির সহিত দাসীটার অবৈধ ঘনিষ্ঠতা ছিল।

পট্টনায়কের চিঠি হইতে শুধু এইটুকুই পরিস্ফুট হয় যে প্রশক্তি কর্মজীবনে একটা বিশিষ্ট প্যাটার্ণ ছিল।

বোমকেশের চিত্তে সুখ নাই। ইন্দিরার চোখে অবার উদ্বেগ ও আশঙ্কা ঘনীভূত হইতেছে। ফণীশ ছট্‌ফট করিতেছে। মণীশবাবু গভীর প্রকৃতির লোক‌, কিন্তু তিনিও যেন একটু অধীর হইয়া উঠিতেছেন। কয়লাখনির অনামা দুৰ্বত্তেরা এখনও ধরা পড়ে নাই।

এই তিন দিনের মধ্যে কেবল একটিমাত্র বিশিষ্ট ঘটনা ঘটিয়াছে যাহার উল্লেখ করা যায়। বিকাশ দত্ত আসিয়াছে এবং কয়লাখনির হাসপাতালে যোগ দিয়াছে। আমরা একদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা করিয়াছে এবং উপদেশ দিয়া আসিয়াছে।

এই তিন দিনের মধ্যে কেবল একটিমাত্র বিশিষ্ট ঘটনা ঘটিয়াছে যাহার উল্লেখ করা যায়। ব্যোমকেশ ক্রমান্বয়ে বিছানায় শুইয়া‌, ঘরে পায়চারি করিয়া অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। তাই কাল সন্ধ্যার পর আমাকে বলিল‌, ‘চল‌, রাস্তায় একটু বেড়ানো যাক।’

রাস্তাটা নির্জন‌, আলো খুব উজ্জ্বল নয়‌, বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে দু’ একজন পদচারী‌, দুই একটি মোটর যাতায়াত করিতেছে। ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল‌, ‘প্রাণহরি পোদ্দারের মত একটা থার্ড ক্লাস লোকের হত্যারহস্য তদন্ত করার কী দরকার? যে মেরেছে বেশ করেছে‌, তাকে সোনার মেডেল দেওয়া উচিত।’

বলিলাম‌, ‘সোনার মেডেল দিতে হলেও তো লোকটাকে চেনা দরকার।’

আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, মোহিনীর কাছে আর একবার যেতে হবে। তাকে একটা কথা জিগ্যেস করা হয়নি।’

এই সময় বাইসাইকেল প্রথম লক্ষ্য করিলাম। আমরা রাস্তার একটু পাশ ঘেষিয়া পায়চারি করিতেছিলাম‌, দেখিলাম সামনের দিকে আন্দাজ পঞ্চাশ গজ দূরে একটা সাইকেল আসিতেছে। সাইকেলে আলো নাই‌, রাস্তার আলোতে আরোহীকে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাহার মাথায় সোলার টুপি মুখখানাকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দেখিতে দেখিতে সাইকেল আমাদের কাছে আসিয়া পড়িল‌, তারপর আরোহী আমাদের পায়ের কাছে একটা সাদাগোছের বস্তু ফেলিয়া দিয়া দ্রুত পেডাল ঘুরাইয়া অদৃশ্য হইল।

0 Shares