ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। দশ হাত দূরে গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি শ্বেতাভ বস্তুটার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু কিছু ঘটিল না, টেনিস বলের মত বস্তুটা জড়বৎ পড়িয়া রহিল। উহা যে বোমা হইতে পারে একথা আমার মাথায় আসে নাই; তখন ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী দেখিয়া আমার বুক ঢ়িবটিব করিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, চাটু করে বাড়ি থেকে একটা টর্চ নিয়ে এস তো।’
সে দাঁড়াইয়া রহিল, আমি পিছু হটিয়া বাড়িতে গেলাম। ফণীশ ও মণীশবাবু দু’জনেই খবর শুনিয়া আমার সঙ্গে আসিলেন।
‘কি ব্যাপার?’ ব্যো
মকেশ বলিল, ‘কাছে আসবেন না। হয়তো কিছুই নয়, তবু সাবধান হওয়া ভাল। অজিত, টর্চ আমাকে দাও।’
টর্চ লইয়া সে ভূ-পতিত বস্তুটার উপর আলো ফেলিল। আমি গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, কাগজের একটা মোড়ক ধীরে ধীরে খুলিয়া যাইতেছে। ব্যোমকেশ কাছে গিয়া আরও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করিয়া বস্তুটা তুলিয়া লইল। হাসিয়া বলিল, ‘কাগজে মোড়া এক টুকরো পাথুরে কয়লা।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘কয়লা–!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কয়লা মুখ্য নয়, কাগজটাই আসল। চলুন, বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক।’
ড্রয়িং-রুমে উজ্জ্বল আলোর নীচে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ সস্তপণে মোড়ক খুলিল। পাথুরে কয়লার টুকরো টেবিলে রাখিয়া কুঞ্চিত কাগজটির দুই পোশ ধরিয়া আলোর দিকে তুলিয়া ধরিল। কাগজটা আকারে সাধারণ চিঠির কাগজের মত, তাহাতে কালি দিয়া বড় বড় অক্ষরে দু’ছত্র লেখা—‘ব্যোমকেশ বক্সী, যদি অবিলম্বে শহর ছাড়িয়া না যাও তোমাকে আর ফিরিয়া যাইতে হইবে না।’
‘কী ভয়ানক, আপনার নাম জানতে পেরেছে।’ মণীশবাবু হাত বাড়াইয়া বলিলেন, ‘দেখি কাগজখানা।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, আপনার ছুঁয়ে কাজ নেই। কাগজে হয়তো আঙুলের ছাপ আছে।’
কাগজখানি সাবধানে ধরিয়া ব্যোমকেশ শয়নকক্ষে আসিল। আমিও সঙ্গে আসিলাম। টেবিলের উপর একটি সচিত্র বিলাতি মাসিকপত্র ছিল, তাহার পাতা খুলিয়া সে কাগজখানি সযত্নে তাহার মধ্যে রাখিয়া দিল। আমি বলিলাম, ‘কোন পক্ষের চিঠি। অবশ্য কয়লা দেখে মনে হয়। কয়লাখনির আসামীরা জানতে পেরেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা ধাপ্পা হতে পারে। গোবিন্দ হালদার জানেন আমি কয়লাখনি সম্পর্কে এখানে এসেছি।’
ড্রয়িং-রুমে ফিরিয়া গিয়া দেখিলাম অফিসের বড়বাবু সুরপতি ঘটক আসিয়াছেন, কর্তার সঙ্গে বোধকরি অফিসঘটিত কোনও পরামর্শ করিতেছেন। আমাদের দেখিয়া সবিনয়ে নমস্কার করিলেন।
তিনি বাক্যালাপ করিয়া প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ মণীশবাবুকে বলিল, ‘আপনি সুরপতিবাবুকে কিছু বলেননি তো?’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘না।–পাঁজি ব্যাটারা কিন্তু ভয় পেয়েছে।’
ব্যেমাকেশ বলিল, ‘ভয় না পেলে আমাকে ভয় দেখাতো না।’
মণীশবাবু খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আপনি তলে তলে কি করছেন আমি জানি না। কিন্তু নিশ্চয় কিছু করছেন, যাতে পাজি ব্যাটারা ঘাবড়ে গেছে। —যাহোক, চিঠি পেয়ে আপনি ভয় পাননি তো?’
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘ভয় বেশি পাইনি। তবু আজ রাত্তিরে দোর বন্ধ করে শোব।’
সকালবেল ফণীশ আমাদের থানায় নামাইয়া দিয়া বলিল, ‘আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে, ইন্দিরার একটা জিনিস চাই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব। অসুবিধা হবে না তো?
‘না। আমরা এখানে ঘণ্টাখানেক আছি।’
ফণীশ মোটর লইয়া চলিয়া গেল, আমরা থানায় প্রবেশ করিলাম।
প্রমোদবাবু টেবিলের সামনে বসিয়া কাগজপত্র লইয়া ব্যস্ত ছিলেন, ব্যোমকেশ সচিত্র বিলাতি মাসিকপত্রটি তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া বলিল, ‘এর মধ্যে এক টুকরো কাগজ আছে, তাতে আঙুলের ছাপ থাকতে পারে। আপনার finger-print expert আছে?
পত্রিকার পাতা তুলিয়া দেখিয়া বরাট বলিলেন, ‘আছে বৈকি। কি ব্যাপার?’
ব্যোমকেশ গত রাত্রির ঘটনা বলিল। শুনিয়া বরাট বলিলেন, ‘কিয়লাখনির ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। এখনি ব্যবস্থা করছি। আজ বিকেলবেলাই রিপোর্ট পাবেন।’
তিনি লোক ডাকিয়া পত্রিকাসমেত কাগজখানা করাঙ্ক বিশেষজ্ঞগণের কাছে পঠাইয়া দিলেন, তারপর বলিলেন, ‘তিনদিন আপনি আসেননি, ওদিকের খবর কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যথা পূর্বং তথা পরং, নতুন কোনো খবর নেই। কিন্তু একটা খট্কা লাগছে?’
‘কিসের খট্কা?’
‘মোহিনীকে প্রাণহরি পনেরো টাকা মাইন দিত। হিসেবের খাতা কিন্তু মোহিনীর মাইনের উল্লেখ নেই।’
বরাট চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ। প্রাণহারির হিসেবের খাতায় দেখছি বিস্তর গলদ। এখন কি করবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহিনীকে প্রশ্ন করে দেখতাম। সে এখনো আছে তো?’
বরাট বলিলেন, ‘দিব্যি আছে, নড়বার নামটি নেই। আমিও ছাড়তে পারছি না, যতক্ষণ না এ মামলার একটা হেস্তনেস্ত হয়–’
‘তাহলে আমরা একবার ঘুরে আসি।’
চলুন।’
না না, আপনার অন্য কাজ রয়েছে, আপনি থাকুন। আমি আর অজিত যাচ্ছি। আপনার সেই তরুণ কনস্টেবলটিকে সেখানে পাব তো?’
বরাট হাসিলেন, ‘আলবৎ পাবেন।’
থানা হইতে বাহির হইলাম। ফণীশের এখনও ফিরিবার সময় হয় নাই, আমরা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডের দিকে চলিলাম।
থানার অনতিদূরে রাস্তার ধারে একটি বিপুল পাকুড় গাছের ছায়ায় ট্যাক্সি দাঁড়াইবার স্থান। সেইদিকে যাইতে যাইতে আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, প্ৰাণহারির সঙ্গে কয়লাখনির ব্যাপারের কি কোনো সম্বন্ধ আছে?
সে বলিল, ‘কিছু না। একমাত্র আমি হচ্ছি যোগসূত্র।’
ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়া দেখিলাম। গাছতলায় মাত্র একটি ট্যাক্সি আছে এবং রাস্তার ধার ঘোষিয়া একটা প্রকাণ্ড কালো–রঙের মোটর আমাদের দিকে পিছন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভুবন দাস কালো মোটরের জানালার কাছে দাঁড়াইয়া চালকের সহিত কথা বলিতেছে। আমরা আর একটু নিকটবর্তী হইতেই কালো মোটরটা চলিয়া গেল। ভুবন দাস নিজের ট্যাক্সির কাছে ফিরিয়া চলিল।