ব্যোমকেশ গভীর ভ্রূকুটি করিয়া বলিল, ‘কার মোটর চিনতে পারলে? গোবিন্দ হালদারের মোটর। প্রথমদিন নম্বরটা দেখেছিলাম।’
‘গোবিন্দ হালদার ট্যাক্সিওয়ালার কাছে কী চায়?’
‘বোধ হয় সাক্ষী ভাঙাতে চায়। এস দেখি।’
আমরা যখন ট্যাক্সির কাছে পৌঁছিলাম তখন ভুবন গাড়ির বুট্ হইতে জ্যাক বাহির করিয়া চাকার নীচে বসাইবার উদ্যোগ করিতেছে। আমাদের দেখিয়া স্যালুট করিল, বলিল, ট্যাক্সি চাই স্যার?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, একবার প্রাণহারিবাবুর বাড়িতে যেতে হবে। সেখানে একজন মেয়েলোক থাকে তার সঙ্গে দরকার আছে।’
ভুবন আড়চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিল, মাথা চুলকাইয়া বলিল, ‘আমার তো একটু দেরি হবে স্যার। টায়ার পাঞ্চার হয়েছে, চাকাটা বদলাতে হবে।’
ব্যোমকেশ অতর্কিতে প্রশ্ন করিল, ‘গোবিন্দ হালদার তোমার সঙ্গে কী কথা বলছিলেন?’
ভুবন চমকিয়া উঠিল, ‘আজ্ঞে?—উনি—উনি আমাকে চেনেন, তাই দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলছিলেন। ভারি ভাল লোক।’ বলিয়া জ্যাকের যন্ত্র প্রবলবেগে ঘুরাইয়া গাড়ির চাকা শূন্যে তুলিতে লাগিল।
ব্যোমকেশের মুখের দিকে চোখ তুলিয়া দেখি সে তন্দ্রাহতের মত দাঁড়াইয়া আছে, তাহার চক্ষু, ভুবনের উপর নিবদ্ধ কিন্তু সে মনশ্চক্ষে অন্য কিছু দেখিতেছে। আমি ডাকিলাম, ‘ব্যোমকেশ।’
সে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বিড়বিড় করিয়া বলিল, ‘অজিত, পনরোর সঙ্গে পয়ত্রিশ যোগ দিলে কত হয়।
বলিলাম, ‘পঞ্চাশ। কী আবোল-তাবোল বকছ?’
সে বলিল, ‘এস।’ বলিয়া থানার দিকে ফিরিয়া চলিল। কিছুদূর গিয়া আমি ফিরিয়া চাহিলাম, ভুবন একাগ্র দৃষ্টিতে আমাদের পানে তাকাইয়া আছে।
থানায় উপস্থিত হইলে বরাট মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘এ কি, গেলেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমোদবাবু্, আপনার থানায় কোনও নিরিবিলি জায়গা আছে? আমি নির্জনে বসে একটু ভাবতে চাই।’
সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। বরাট তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বলিলেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
থানার পিছন দিকে একটি ঢাকা বারান্দা, লোকজন নেই, কয়েকটা চেয়ার পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ একটি ইজি-চেয়ারে লম্বা হইয়া সিগারেট ধরাইল। বরাট মৃদু হাসিয়া প্রস্থান করিলেন।
আধা ঘণ্টার মধ্যে গোটা পাঁচেক সিগারেট নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, হয়েছে।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, কী হয়েছে?’
সে বলিল, ‘দিব্যচক্ষু উম্মীলিত হয়েছে, সত্যদর্শন হয়েছে। এস।’
বরাটের ঘরে গিয়া তাঁহার টেবিলের পাশে দাঁড়াইতেই তিনি উৎসুক মুখ তুলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমোদবাবু্, কোন ব্যাঙ্কে প্রাণহরির টাকা আছে?’
বরাট বলিলেন, ‘সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে। কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সেখানে সেফ-ডিপজিট ভল্ট আছে কিনা জানেন?ট
‘আছে বোধ হয়।’
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতক্ষণ ব্যাঙ্ক খুলেছে। —চলুন।’
বরাট আর প্রশ্ন না করিয়া উঠিয়া পড়িলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম ফণীশ ফিরিয়াছে এবং গাড়ি হইতে নামিবার উপক্রম করিতেছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘নেমো না, আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিতে হবে।’
শহরের মাঝখানে ব্যাঙ্কের বাড়ি, দ্বারে বন্দুকধারী শান্ত্রীর পাহারা। গাড়ি হইতে নামিবার পূর্বে ব্যোমকেশ ফণীশকে বলিল, ‘ফণীশ, তুমি বাড়ি যাও, আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে।–ভালো কথা, বৌমার বাপের বাড়ি কোথায়?’
ফণীশ সবিস্ময়ে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল, ‘নবদ্বীপে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। তাহলে নিশ্চয় মালপো তৈরি করতে জানেন। তাঁকে বলে দিও আজ বিকেলে আমরা মালপো খাব।’
আমরা নামিয়া গেলাম, ফণীশ একটু নিরাশভাবে গাড়ি লইয়া চলিয়া গেল। সে বুঝিয়াছিল, প্রাণহোরর মৃত্যুরহস্য সমাধানের উপান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
বিরাট আমাদের ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ঘরে লইয়া গেলেন; ম্যানেজারের সঙ্গে তাঁহার আগে হইতেই আলাপ ছিল। বলিলেন, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দারের ব্যাপারে এসেছি। আপনার ব্যাঙ্কে সেফ-ডিপজিট ভল্ট আছে?
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আছে।’
বরাট ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দার ভল্ট ভাড়া নিয়েছিলেন নাকি?’
ম্যানেজার একজন কর্মচারীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সে বলিল, ‘হ্যাঁ, নিয়েছিলেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তার সেফ-ডিপজিট কী আছে আমরা দেখতে চাই।’
ম্যানেজার কুণ্ঠিত হইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু ব্যাঙ্কের নিয়ম নেই। অবশ্য যদি পরোয়ানা থাকে—’
বরাট বলিলেন, ‘প্রাণহরি পোদ্দারকে খুন করা হয়েছে। তার সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ, কাগজপত্র অনুসন্ধান করবার পরোয়ানা পুলিসের আছে।’
ম্যানেজার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘বেশ। চাবি এনেছেন?’
‘চাবি?’
‘সেফ-ডিপজিটের প্রত্যেকটি বাক্সের দুটো চাবি; একটা থাকে যিনি ভাড়া নিয়েছেন তাঁর কাছে, অন্যটা থাকে ব্যাঙ্কের জিন্মায়। দুটো চাবি না পেলে বাক্স খোলা যায় না।’
ব্যোমকেশ বরাটের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিল। বিরাট বলিলেন, ‘ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় আছে?’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আছে। কিন্তু ব্যাঙ্কের ডিরেকটারদের হুকুম না পেলে আপনাদের দিতে পারি না। হুকুম পেতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে।’
ব্যোমকেশ বরাটকে বলিল, ‘চলুন, আর একবার প্রাণহোরর সিন্দুক খুঁজে দেখা যাক। নিশ্চয় ওই ঘরেই কোথাও আছে।’
বরাট উঠিলেন, ম্যানেজারকে বলিলেন, ‘আমরা আবার আসছি। যদি চাবি খুঁজে না পাই, দরখাস্ত করব।’
আমরা থানায় ফিরিয়া গেলাম, সেখান হইতে আরও দুইজন লোক লইয়া পুলিস-কারে প্ৰাণহারির বাড়িতে উপনীত হইলাম।