আজ তরুণ কনস্টেবলটি বাড়ির সামনে টুল পাতিয়া বসিয়া ছিল, আমাদের দেখিয়া সাড়ম্বরে স্যালুট করিল।
দ্বারের সামনে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ বরাটকে বলিল, ‘আমি মোহিনীকে দু-একটা প্রশ্ন করি, ততক্ষণ আপনারা ওপরের ঘর তল্লাশ করুন গিয়ে। আমার বিশ্বাস চাবি খুঁজে বার করা শক্ত হবে না। হয়তো সিন্দুকেই আছে, আপনারা লুকোনো জিনিস খোঁজেননি, তাই পাননি। তখন তো আপনারা জানতেন না যে প্ৰাণহারির সেফ-ডিপজিট আছে।’
পুলিসের দল সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ও আমি রান্নাঘরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম।
মোহিনী দ্বারের দিকে পিছন ফিরিয়া রান্না করিতেছিল, আমাদের পদশব্দে ঘাড় ফিরাইয়া চাহিল। আমাদের দেখিয়া চকিত ত্ৰাসে তাহার চক্ষু একবার বিস্ফারিত হইল, তারপর সে উনান হইতে কড়া নামাইয়া আচলে হাত মুছিতে মুছিতে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
‘কিছু দরকার আছে বাবু? তাহার ক্ষণিক ত্ৰাস কাটিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুমি এখনো আছ দেখছি। দেশে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’
মোহিনী বলিল, ‘কি করব বাবু্, পুলিস ছেড়ে না দিলে যাই কি করে?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তোমার বাপ-মাকে কিংবা স্বামীকে খবর দিয়েছ?’
মোহিনী ক্ষণকাল চক্ষু নত করিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘স্বামী কোথায় জানি না। বাপ-মাকে খবর দিইনি। তারা বুড়ো মানুষ, কি হবে তাদের খবর দিয়ে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। আচ্ছা, একটা কথা বল দেখি, যে-রাত্রে প্রাণহারিবাবু খুন হয়েছিলেন, সে-রাত্রে তিনি যখন খেতে নামলেন না, তখন তুমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলে?’
মোহিনী সায় দিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ বাবু।’
‘ঘরে আলো জ্বলছিল?’
‘হ্যাঁ বাবু।’
‘ঘরের পিছন দিকের দরজা, অর্থাৎ স্নানের ঘরের দরজা খোলা দেখেছিলে?’
‘না বাবু।’ মোহিনীর চোখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল।
‘দরজা বন্ধ ছিল?’
পলকের জন্য মোহিনী দ্বিধা করিল, তারপর বলিল, ‘আমি কিছুই দেখিনি বাবু। কর্তাবাবু মরে পড়ে আছেন দেখে ছুটে পালিয়ে এসেছিলুম।’
‘তুমি স্নানের ঘরের দরজা বন্ধ করে দাওনি?’
‘আজ্ঞে না।’
‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ একটু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল, ‘প্রাণহারবাবু তোমাকে পনেরো টাকা মাইনে দিতেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘প্রতি মাসে ঠিক সময়ে মাইনে দিতেন?’
মানুষ যখন মনে মনে এক কথা ভাবে এবং মুখে অন্য কথা বলে তখন তাহার মুখ দেখিয়া বোঝা যায়, তেমনি অন্যমনস্কভাবে মোহিনী বলিল, ‘আমার মাইনে কর্তাবাবুর কাছে জমা থাকত, দরকার হলে দুএক টাকা চেয়ে নিতুম।’
ব্যোমকেশের পানে কটাক্ষপাত করিয়া দেখিলাম সে মৃদু হাসিতেছে। সে বলিল, ‘তোমার মাইনের টাকা বোধহয় মারা গেল। আচ্ছা, এবার আমার শেষ প্রশ্ন : তুমি কোনো ন্যাটা লোককে চোন?’
মোহিনী অবাক হইয়া বলিল, ‘ন্যাটা লোক! সে কাকে বলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ন্যাটা জান না? যে ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাত বেশি চালায় তাকে ন্যাটা বলে।’
মোহিনী সহসা বুকের উপর হাত রাখিয়া বলিল, ‘না। বাবু্, সে রকম কাউকে আমি চিনি না।’
মোহিনী দাঁড়াইয়া রহিল, আমরা উপরে প্রাণহারির শয়নকক্ষে উঠিয়া গেলাম।
চাবি পাওয়া গিয়াছে। বেশি খোঁজাখুঁজি করিতে হয় নাই; সিন্দুক ও দেয়ালের মাঝখানে যে স্বল্প-পরিসর স্থান ছিল সেই স্থানে সিন্দুকের পিঠে চাবিটা মোম দিয়া আটকানো ছিল। বরাট বলিল, ‘এই নিন।’
নম্বর খোদাই করা লম্বা একটি চাবি। ব্যোমকেশ তাহা পরিদর্শন করিয়া বলিল, ‘চলুন আবার ব্যাংকে।’
ব্যাঙ্কে গিয়া ম্যানেজারের নিকট চাবি পেশ করা হইল। তিনি এবার আর দ্বিরুক্তি করিলেন না, স্বয়ং উঠিয়া আমাদের ভল্টে লইয়া গেলেন। ব্যাঙ্কের বাড়ির নীচে মাটির তলায় ঘর, তাহার তিনটি দেয়াল জুড়িয়া কাতারে কাতারে দ্বারযুক্ত স্টীলের খোপ শোভা পাইতেছে।
দুইটি চাবি মিলাইয়া প্রাণহারির খোপের কবাট খোলা হইল। খোপের মধ্যে টাকাকড়ি, গয়নাগটি কিছু নাই, কেবল কয়েকটি পুরাতন চিঠি এবং এক বাণ্ডিল বন্ধকী তমসুক।
চিঠিগুলি প্রাণহরিকে লেখা নয়, প্রাণহারির দ্বারাও লিখিত নয়। অজ্ঞাতনামা পুরুষ বা নারীর দ্বারা অজ্ঞাতনামা লোকের নামে লেখা। সম্ভবত এই পত্রগুলিকে অস্ত্র করিয়া প্ৰাণহরি লেখক ও লেখিকাদের রুধির শোষণ করিতেন।
চিঠিগুলিতে ব্যোমকেশের প্রয়োজন ছিল না, সে তমসুকগুলি লইয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ম্যানেজারের ঘরে বসিয়া সে একে একে তমসুকগুলিতে চোখ বুলাইল। তারপর একটি তমসুক তুলিয়া ধরিয়া বরাটকে বলিল, ‘এই নিন। আপনার আসামী।’
তমসুকে আইনসঙ্গত ভাষায় লেখা ছিল, মহাজন প্রাণহরি পোদ্দার ভগবানপুর নিবাসী ভুবনেশ্বর দাসকে ক্ৰেতব্য মাটরগাড়ি বন্ধক রাখিয়া আড়াই হাজার টাকা কর্জ দিয়াছেন। কীভাবে ভুবনেশ্বর দাস এই ঋণ শোধ করিবে তাহার শর্তও দলিলে লেখা আছে : পঞ্চাশ টাকা নগদ; প্রাণহরি মোটর ব্যবহার করিবেন তাহার মাসিক ভাড়া পাঁচশ টাকা; একুনে পঁচাত্তর টাকা হিসাবে মাসে শোধ হইবে।
বরাট ভ্রূ তুলিয়া বোমকেশের পানে চাহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার কাজ শেষ হয়েছে, এবার যা করবার আপনি করবেন।’
বরাট বলিলেন, ‘কিন্তু খুনের প্রমাণ?’
‘প্রমাণ আছে। তবে আদালতে দাঁড়াবে কিনা বলতে পারি না। এবার আমরা বাড়ি ফিরব, বেলা দেড়টা বেজে গেছে।’
‘চলুন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।’
পুলিস-কারে যাইতে যাইতে বেশি কথা হইল না। একবার বিরাট বলিলেন, ‘ভুবনকে অ্যারেস্ট করি তাহলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘করুন। সে যদি স্বীকার করে তাহলে সব ন্যাটা চুকে যাবে।’