বাড়ির ফটকের সামনে আমাদের নামাইয়া দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল, বরাট বলিয়া গেলেন, ‘বিকেলবেলা আসব।’
অপরাহ্নে আন্দাজ পাঁচটার সময় আমরা ক্ষীরের মালপোয়া লইয়া বসিয়াছি এমন সময় প্রমোদ বরাট আসিলেন।
মণীশবাবু কয়লাখনিতে গিয়াছেন, ফণীশ বাড়িতে আছে। ইন্দিরা এতক্ষণ আমাদের কাছেই ছিল, এখন বিরাটকে দেখিয়া ভিতরে গিয়াছে। আসামী কে তাহা শুনিবার পর আমার মাথাটা হিজিবিজি হইয়া গিয়াছিল, এখন কতকটা ধাতে আসিয়াছে।
ইন্সপেক্টর বরাটের মুখখানা শুষ্ক, মন বিক্ষিপ্ত; সকালবেলা যে ইউনিফর্ম পরিয়া ছিলেন, এখনও তাঁহাই পরিয়া আছেন মনে হয়। তিনি আসিয়া হাস্যহীন মুখে পকেট হইতে একটি খাম বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন; বলিলেন, ‘এই নিন। আঙুলের ছাপের ফটো আর রিপোর্ট। তিনজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।’
ব্যোমকেশ খামটি না খুলিয়াই পকেটে রাখিল, বরাটের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, ‘আজ দুপুরে আপনার খাওয়া হয়নি দেখছি।’
বরাট মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘খাওয়া হবে কেথেকে। আপনার আসামী পালিয়েছে।’ ব্যোমকেশ এমনভাবে ঘাড় নাড়িল যেন ইহার জন্য সে প্রস্তুত ছিল। তারপর বিরাটকে বসিতে বলিয়া সে ফণীশের পানে চাহিল। ফণীশ দ্রুত অন্দরের দিকে চলিয়া গেল। বিরাট হেলান দিয়া ক্লান্ত স্বরে বলিলেন, ‘শুধু আসামী নয়, মোহিনীও পালিয়েছে। দু’জনে ট্যাক্সিতে চড়ে হাওয়া হয়েছে। কনস্টেবলটা প্ৰাণহারির বাড়িতে পাহারায় ছিল, কিন্তু মোহিনীকে আটক করবার হুকুম তার ছিল না। ভুবন দাস ট্যাক্সিতে এসে রাস্তা থেকে হর্ন বাজালো, মোহিনী বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। দু’জনে চলে গেল।’
ফণীশ এক থালা খাবার আনিয়া বরাটের সম্মুখে রাখিল, বরাট বিমৰ্ষভাবে আহার করিতে লাগিলেন। আমরাও মালপোয়াতে মন দিলাম। নীরবে আহার চলিতে লাগিল।
বৈষ্ণবীয় জলযোগ সমাধা করিয়া সিগারেট ধরাইবার উপক্রম করিতেছি, বাহিরের দিক হইতে আদলি জাতীয় একটি লোক ঘরে প্রবেশ করিল। মাথায় গান্ধী-টুপি, পরিধানে খন্দরের চাপকন ও পায়জামা; তাই হঠাৎ তাহাকে চিনিতে পারি নাই। সে মাথার টুপি খুলিয়া মেঝোয় আছাড় মারিল। তারপর বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলিল, ‘শালাদের ধরেছি স্যার।’
বিকাশ দত্ত। টুপি খুলিতেই তাহার স্বরূপ প্রকাশ হইয়াছে। ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া বলিল, ‘এস এস বিকাশ। কাজ সেরে ফেলেছি তাহলে?’
‘সেরেছি স্যার। আমার মাথা ফাটাবার তালে ছিল, তাতেই ধরা পড়ে গেল।’ বিকাশ হাত-পা ছড়াইয়া একটা সোফায় বসিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, ‘দু’জনেই শালা।’
‘দু’জনেই শালা-কাদের কথা বলছ?’
বিকাশ উত্তর দিবার পূর্বেই সুরপতি ঘটক প্রবেশ করিলেন। শৌখিন বেশবাস সত্ত্বেও একটু ভিজাবিড়াল ভাব, চোখে সতর্ক বিড়ালদৃষ্টি। তিনি ঘরের পরিস্থিতি ক্ষিপ্র-মসৃণ চক্ষে দেখিয়া লইয়া বিনীত স্বরে বলিলেন, ‘কর্তা আছেন কি? তাঁর সঙ্গে—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন সুরপতিবাবু।’
বিকাশ সহসা খাড়া হইয়া বসিল, একাগ্র চক্ষে সুরপতিবাবুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘এঁর নাম সুরপতি ঘটক? বড় অফিসের বড়বাবু?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। কেন বল দেখি?’
বিকাশ সুরপতিবাবুর দিকে তর্জনী নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এঁর দুই শালার কথা বলছিলাম স্যার। বিশ্বনাথ আর জগন্নাথ রায়। তারাই কয়লাখনিতে বজ্জাতি করছে।’
সুরপতির চোখে ভয় উছলিয়া উঠিল, তিনি শীর্ণকণ্ঠে বলিলেন, ‘কী? কী? আমি তো কিছু—’
বরাট তাঁহার দিকে ধীরে ধীরে চক্ষু ফিরাইয়া নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুরপতিবাবু্, যে দু’টি ছোকরাকে আপনি আমাদের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টায় ছিলেন, তারা আপনার শালা?’
সুরপতিবাবু বলিলেন, ‘মানে—তাতে কি হয়েছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়নি কিছু। কাল রাত্রে আমি একটা চিঠি পেয়েছি, তাতে তিনজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। আমরা মিলিয়ে দেখতে চাই, তিনজনের মধ্যে আপনি আছেন। কিনা—ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি সুরপতিবাবুর আঙুলের ছাপ নিন। মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে উনি এই ষড়যন্ত্রে কতদূর আছেন। ফণীশ, বাড়িতে রবারস্ট্যাম্প-কালির প্যাড আছে?’
সুরপতিবাবু এক-পা এক-পা করিয়া পিছু হটতেছিলেন, দ্বারের কাছাকাছি গিয়া তিনি পাক খাইয়া পালাইবার চেষ্টা করিলেন। ঘটনাক্রমে এই সময় মণীশবাবু ঘরে প্রবেশ করিতেছিলেন, দুজনেই পড়িতে পড়িতে তাল সামলাইয়া লইলেন, তারপর সুরপতি ঘটক তুরঙ্গ গতিতে পলায়ণ করিলেন।
মনীশবাবু এইমাত্র কয়লাখনি হইতে ফিরিয়াছেন, ঘরে প্রবেশ করিয়া বিস্ময়ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে চাহিলেন। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম। তিনি বলিলেন, কী হচ্ছে এখানে?–ইন্সপেক্টর বরাট–সুরপতি আমন লাফ মেরে পালালো কেন?’
বরাট বলিলেন, ‘আপনি বসুন। আপনার খনিতে যারা অনিষ্ট করছিল তারা ধরা পড়েছে।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘ধরা পড়েছে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ছেলেটির নাম বিকাশ দত্ত, ও আমার সহকারী। ইন্সপেক্টির বরাটের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকাশকে হাসপাতালের আর্দালি সাজিয়ে খনিতে পাঠিয়েছিলাম। ও ধরেছে।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘কে-কারা-?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুরপতি ঘটক ও তার দুই শালা।’
‘অ্যাঁ! সুরপতি!’ মণীশবাবু চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন, ‘কিন্তু–সুরপতি! সে যে আমার অফিসে বিশ বছর কাজ করছে। তার এই কাজ।’
আমরা আবার উপবেশন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘মণীশবাবু্, দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করলে মানুষ স্ত্রীর বশীভূত হয়, সুরপতিবাবু শালাদের বশীভুত হয়েছেন। খুব বেশি তফাৎ নেই।’