মনীশবাবু বলিলেন, ‘কিন্তু কেন? ওরা আমার অনিষ্ট করতে চায় কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সেটা এখনো আবিষ্কার করা যায়নি। তবে আবিষ্কার করা শক্ত হবে না। আমার মনে হয়, যে মাড়োয়ারি আপনার খনি কিনতে চেয়েছিল। সেই আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কিংবা অন্য কেউ হতে পারে। সুরপতিবাবুকে চাপ দিলেই বেরিয়ে পড়বে।’
‘কিন্তু–সুরপতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু পেয়েছেন?’
‘এখনো পাইনি। কিন্তু আঙুলের ছাপ নেবার নামে উনি যেরকম লাফ মেরে পালালেন, ওঁর মনে পাপ আছে।’
মণীশবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। মনে হইল, তিনি যত না বিস্মিত হইয়াছেন, ততোধিক দুঃখ পাইয়াছেন। তিনি বলিলেন, ‘আপনারা বসুন। ফণী, তুমি আমার সঙ্গে এস। অফিসের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর সুরপতির–তিনি সপ্রশ্ন নোত্রে বরাটের পানে চাহিলেন।
বরাট বলিলেন, ‘সুরপতির ব্যবস্থা আমি করব।’
মণীশবাবু পুত্রকে লইয়া অফিসের দিকে চলিয়া গেলেন।
আমরা চারজন কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ অলসকণ্ঠে বলিল, ‘ভুবনের নামে হুলিয়া জারি করেছেন নিশ্চয়?’
বরাট বলিলেন, ‘সারাদিন তাতেই কেটেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আশাপ্রদ কোনো খবর নেই?’
বরাট বলিলেন, ‘চল্লিশ মাইল দূরে একটা রেলওয়ে স্টেশন থেকে খবর পেয়েছি, একটা চালকহীন নম্বরহীন ট্যাক্সি সেখানে পড়ে আছে। লোক পাঠিয়েছি। হয়তো ভুবনের ট্যাক্সি্্, সে ওখানে ট্যাক্সি ছেড়ে ট্রেন ধরেছে।’
‘বোম্বাই গেছে কি মাদ্রাজ গেছে কে জানে।’
‘হুঁ। আজ উঠি।’
‘আচ্ছা, আসুন। আসামীকে ধরা আপনার কর্তব্য, আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন জানি। তবু্, যদি ওদের ধরতে না পারেন। আমি খুশি হব।’
ইন্সপেক্টর বিরাট একটু হাসিলেন।
৫
নৈশ আহারের পর মণীশবাবু শয়ন করিতে গিয়াছিলেন; ফণীশ চুপি চুপি আসিয়া আমাদের ঘরে ঢুকিল। আজ আমাদের ঘরে তিনজনের শয়নের ব্যবস্থা, বিকাশের জন্য একটি ক্যাম্প খাট পাতা হইয়াছে।
ঘরে তিনজনেই উপস্থিত ছিলাম, বিছানায় শুইয়া সিগারেট টানিতেছিলাম; বিকাশ কি করিয়া শালদের ধরিল তাঁহারই গল্প বলিতেছিল। ফণীশকে দেখিয়া ব্যোমকেশ বালিশে কনুই দিয়া উঁচু হইয়া বসিল।
‘এস ফণীশ।’
ফণীশ ব্যোমকেশের খাটের পাশে চেয়ার টানিয়া বসিল, অনুযোগের সুরে বলিল, ‘কালই চলে যাবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, শালাবাবুরা যে রকম শাসিয়েছে তাড়াতাড়ি কেটে পড়াই ভাল। তুমি যদি বৌমাকে নিয়ে কলকাতায় আসো নিশ্চয় আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। বৌমাকে সত্যবতীর খুব পছন্দ হবে।’ বলিয়া যেন পুরাতন কথা স্মরণ করিয়া একটু হাসিল।
ফণীশ ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, ‘গল্পটা শুনব।’
ব্যোমকেশ বিছানার উপর উঠিয়া বসিল, মাথার বালিশটা কোলের উপর টানিয়া লইয়া বলিল, ‘গল্প শুনবে-প্রাণহারির গল্প? বেশ, বলছি; কিন্তু গল্পটা গল্পই হবে, আগাগোড়া সত্য ঘটনা হবে। না। অনেকটা ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত।’
ফণীশ ভ্রূ তুলিয়া প্রশ্ন করিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝলে না? যাঁরা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন তাঁরা সরাসরি ইতিহাস লেখেন না, ইতিহাস থেকে গোটা-কয়েক চরিত্র এবং ঘটনা তুলে নিয়ে সেই কাঠামোর ওপর নিজের গল্প গড়ে তোলেন। আমি তোমাকে যে গল্প বলব সেটাও অনেকটা সেই ধরনের হবে। সব ঘটনা জানি না, যেটুকু জানি তা থেকে পুরো গল্পটা গড়ে তুলেছি; কল্পনা আর সত্য এ গল্পে সমান অংশীদার।–শুনতে চাও?’
ফণীশ বলিল, ‘বলুন।’
ব্যোমকেশ নূতন সিগারেট ধরাইয়া গল্প আরম্ভ করিল—
ভুবনেশ্বর দাসকে দিয়েই গল্প আরম্ভ করি। তার নাম শূনেও আমার সন্দেহ হয়নি যে সে বাঙালী নয়, ওড়িয়া। বাংলাদেশ আর উড়িষ্যার সঙ্গমস্থলে যারা থাকে তারা দুটো ভাষাই পরিষ্কার বলতে পারে, বোঝবার উপায় নেই বাঙালী কি ওড়িয়া। যদি বুঝতে পারতাম, সমস্যাটা অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত। কারণ মোহিনী উড়িষ্যার মেয়ে। দুই আর দুয়ে চার।
মোহিনী ভুবনেশ্বরের বৌ। যারা মেয়ে-মরদে গতর খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করে ওরা সেই শ্রেণীর লোক। ভুবন কাজ করত কটকের একটা মোটর মেরামতির কারখানায়। মোহিনী বাঙালী গৃহস্থের বাড়িতে দাসীবৃত্তি করত। আর দু’জনে দু’জনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো। এই ভালবাসাই হচ্ছে। এ গল্পের মূল সূত্র।
ভুবনের মনে উচ্চাশা ছিল, মোহিনীর দাসীবৃত্তি তার পছন্দ ছিল না। মোটর কারখানায় কাজ করতে করতে মিলিটারিতে ট্রাক-ড্রাইভারের চাকরি যোগাড় করে সে চলে গেল; মোহিনীকে বলে গেল-টাকা রোজগার করে ট্যাক্সি কিনব, তোকে আর চাকরি করতে হবে না।
বছর দুই ভুবনের আর দেখা নেই। ইতিমধ্যে মোহিনী কটকে প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়িতে চাকরি করছে; দিনের বেলা কাজকর্ম করে, রাত্তিরে বাপ-মায়ের কাছে ফিরে যায়।
প্রাণহরি লোকটা অতিবড় অর্থাপিশাচ। যেমন কৃপণ তেমনি লোভী। সারা জীবন টাকাটাকা করে বুড়ো হয়ে গেছে, জুছুরি দাগাবাজি ব্ল্যাকমেল করে অনেক টাকা জমা করেছে, তবু তার টাকার ক্ষিদে মেটেনি। স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তার মনে লোভ নেই, কিংবা বুড়ো বয়সে সে লোভ কেটে গিয়েছিল। কিন্তু মোহিনী যখন তার বাড়িতে চাকরি করতে এল তখন তাকে দেখে প্রাণহারির মাথায় এক কুবুদ্ধি গজালো, সে টাকা রোজগারের নতুন একটা রাস্তা দেখতে পেল। বড় মানুষের উদ্ধৃঙ্খল ছেলেরা তার বাড়িতে জুয়া খেলতে আসে, তাদের চোখের সামনে মোহিনীর মত মেয়েকে যদি ধরা যায়–
মোহিনীর দেহে যে প্রচণ্ড যৌন আকর্ষণ আছে তাই দেখে তার চরিত্র সম্বন্ধে প্ৰাণহারির মনে ভুল ধারণা জন্মেছিল। সে বড়মানুষের ছেলেদের ধাপ্পা দিয়ে মোহিনীর নাম করে টাকা নিত। কিন্তু মোহিনী ধরা-ছোঁয়া দিত না। কিছুদিন এইভাবে চলাবার পর বড়মানুষের ছেলেরা বিগড়ে গেল, তারা টাকা ঢেলেছে, ছাড়বে কেন? তারা প্ৰাণহারিকে প্রহার দেবার মতলব করল।