কহেন কবি কালিদাস

ভুবন তখন সাবধানে সামনের দরজা খুলল। তার বোধ হয় মতলব ছিল সামনের দিকে সাড়াশব্দ না পেলে সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে‌, পিছনের দরজা বন্ধ থাকবে। কিন্তু সামনে বোধহয় তখন এরা চারজন সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছিল। তাই ভুবন সামনের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যো-পথে এসেছিল। সেই পথে ফিরে গেল। স্প্যানারটা সঙ্গে নিয়ে গেল। এখন পরিস্থিতি দাঁড়াল‌, সামনের দরজাও খোলা‌, পিছনের দরজাও খোলা। প্রাণহোরর আততায়ী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে অনুমান করা শক্ত।

অরবিন্দ প্রথম বার প্রাণহোরর দরজা বন্ধ পেয়েছিল; দ্বিতীয় বার চারজনে উঠে দেখল। দরজা খোলা এবং প্রাণহরি পোদ্দার ইহলীলা সম্বরণ করেছে। তারা দুদ্দাড় শব্দে পালালো। ট্যাক্সির কাছে ফিরে গিয়ে দেখল ট্যাক্সি-ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। তারা ড্রাইভারকে জাগিয়ে শহরে ফিরে গেল।

ওদিকে মোহিনী রান্না করছিল‌, সে কিছুই জানতে পারেনি। রান্নার ছাকৈছোঁক শব্দে দুরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল। রান্না শেষ হবার পর সে যখন দেখল। বুড়ো খেতে নামছে না‌, তখন সে ওপরে গেল। সে দেখল প্ৰাণহরি মারে পড়ে আছে‌, সামনের এবং পিছনের দরজা খোলা। অরবিন্দের কথা তার মনে এল না। তার মনে এল ভুবনের কথা। যেখানে ভালোবাসা সেখানেই শঙ্কা। ভুবনকে সে ইশারা দিয়েছিল‌, বুড়ো লোক ভাল নয়। ভুবন বাইরে বেশ ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ‌, কিন্তু তার ভিতরে আছে প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারের উগ্রতা। স্ত্রীর অমযদি সে সহ্য করবে না।

মোহিনী মেয়েটা ভারি বুদ্ধিমতী। মড়া দেখেও তার মাথা খারাপ হল না‌, সে চট্ট করে কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুন যেই করুক‌, তাকে যেন পুলিস ধরতে না পারে। হত্যাকারী স্নানঘরের দোর দিয়ে ঢুকেছে এবং সেই দিক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছে‌, মোহিনীর তাতে সন্দেহ নেই। সে পিছন দিকের দরজা দুটো ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল‌, তারপর ট্রাক-ড্রাইভার মারফত পুলিসে খবর পাঠালো। কী সাংঘাতিক মেয়ে দ্যাখো‌, একটুকু বাড়াবাড়ি করেনি। পুলিসকে ভুল রাস্তায় চালাবার জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু করেছে।

মোহিনী আমাদের আছে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে‌, কিন্তু কখনো অনাবশ্যক। মিথ্যে কথা বলেনি। ভুবনও তাই। আমার বিশ্বাস যে-রাত্রে খুন হয় সেই রাত্রেই কোনো সময় ভুবন ফিয়ে গিয়ে মোহিনীকে সব কথা বলেছিল এবং তারপর থেকে প্রায়ই গিয়ে দেখা করত। এই জন্যেই মোহিনী খুনের পর বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি। ভুবনের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখা নিতান্ত দরকার।

যাহোক, আমি যখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলাম তখন পুলিসের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি পড়েছে চারজন আসামীর ওপর। মোটিভ এবং সুযোগ এদের পুরোদস্তুর বিদ্যমান। হয় এরা চারজনে একজোট হয়ে খুন করেছে‌, নয়তো ওদের মধ্যে একজন খুন করেছে। অন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে।

পুলিসের সঙ্গে আমার মতভেদের কোনো কারণ ছিল না; তবু একজোট হয়ে খুন করার প্রস্তাবটা হজম করা শক্ত। সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা মধ্যভারতের ডাকাত নয়‌, তারা সমাজবাসী তথাকথিত সভ্য মানুষ। তারা দল বেঁধে খুন করবে না।

কিন্তু ওদের মধ্যে একজন অন্য তিনজনের চোখে ধুলো দিয়ে খুন করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে‌, লোকটা কে? সবচেয়ে বেশি সন্দেহ অরবিন্দ হালদারের ওপর। সে শুধু জুয়াতেই ঠিকেনি‌, আর এক বিষয়ে ঠিকেছে; যার জন্যে তার লজার অবধি নেই; যে কথা সে কারুর কাছে স্বীকার করতে পারে না। লম্পটের লজ্জা এক বিচিত্র বস্তু; সে কেবল তখনি লজ্জা পায় যখন দুহাজার টাকা খরচ করেও সে তার নির্লজ্জ কামনার বস্তু পায় না।

অনুসন্ধান আরম্ভ করে আমার খটকা লাগল। প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমার মনে মাথা তুলল। সেটি হচ্ছে-মারণাস্ত্রটা গেল কোথায়? ডাক্তার ঘোষাল যে ধরনের বর্ণনা দিলেন সে রকম কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি; অরবিন্দের দলের কেউ যদি অস্ত্র আনতো তাহলে ফণীশ আর ভুবনের চোখ এড়াতে পারতো না। সুতরাং ওরা অস্ত্রটা আনেনি‌, নিয়েও যায়নি। তবে সেটা এল কোথেকে এবং গেল কোথায়?

দ্বিতীয় কথা‌, ডাক্তার ঘোষালের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে‌, হত্যাকারী লোকটা ন্যাটা। ভেবে দ্যাখো‌, প্রাণহারির শোবার ঘরে একটা চেয়ার পর্যন্ত নেই; সে আততায়ীর দিকে পিছন ফিরে তক্তপোশের কিনারায় বসেছিল একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আততায়ী তাকে মেরেছে‌, আঘাত লেগেছে মাথার ডানদিকে সিঁথির মত। সুতরাং আততায়ী ন্যাটা‌, তার বাঁ হাত বেশি চলে।

চারজন আসামীয় মধ্যে কে ন্যাটা খোঁজ করলাম। কয়লা ক্লাবে গিয়ে দেখলাম‌, মৃগেন মৌলিক ডান হাতে টেনিস খেলছে‌, মধুময় সুর আর অরবিন্দ হালদার ডান হাতে তাস ভেঁজে তাস বাঁটছে এবং খেলছে। তখন ফণীশের দিকে কাচের কাগজ চাপা গোলা ফেলে দেখলাম। সেও ডান হাতে গোলা ধরল। ওরা কেউ ন্যাটা নয়।

কিন্তু ন্যাটা না হোক‌, ওদের মধ্যে কেউ সব্যসাচী হতে পারে। কাজেই ওদের একেবারে ত্যাগ করতে পারলাম না। ওরা ছাড়া সন্দেহভাজন আর কেউ নেই। মোহিনী খুন করেনি‌, তার খুন করবার ইচ্ছে থাকলে সে প্রাণহারিকে বিষ খাওয়াতো; তার মোটিভও কিছু নেই।

আমি কোনো দিকে দিশা খুঁজে পাচ্ছি না‌, এমন সময় এক মুহুর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল; যেন মেঘে ঢাকা অন্ধকার রাত্রে বিদ্যুৎ চমকালো। দেখলাম ভুবন তার ট্যাক্সির চাকার তলায় জ্যাক বসিয়ে বাঁ হাতে ঘোরাচ্ছে!

খুনের রাত্রে ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভুবনেশ্বর দাস যে অকুস্থলে উপস্থিত ছিল তা আমরা সকলেই জানতাম‌, অথচ তার কথা একবারও মনে আসেনি। একেই জি. কে. চেস্টারটন বলেছেন‌, অদৃশ্য মানুষ–Invisible Man.

0 Shares