কহেন কবি কালিদাস

সামনের ঘর হইতে একটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বাহির হইয়া আসিলেন। পরিধানে ফরাসডাঙ্গার ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি‌, ফিটফট চেহারা। চুলে নিশ্চয় কলপ লাগাইয়া থাকেন‌, কালো চুলের নীচে শ্বেতবর্ণ অন্ধুর মাথা তুলিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার নাম গগন মিত্র‌, ইনি সুজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। মণীশবাবুর অতিথি।’

ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হইয়া আমাদের সংবর্ধনা করিলেন‌, ‘আসুন‌, আসুন। আপনারা আসবেন কর্তার মুখে শুনেছিলাম। আমি সুরপতি ঘটক‌, এই অফিসের দেখাশোনা করি।’

সুরপতিবাবু আমাদের প্রকৃত নাম জানেন না। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা বুঝি কয়লাখনির অফিস। আপনি অফিস-মাস্টার।’

সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে। কয়লাখনিতে একটা ছোট অফিস আছে‌, এটা বড় অফিস। আসুন না দেখবেন।’

ঘরগুলি একে একে দেখিলাম। বিভিন্ন ঘরে কেরানিরা খাতপত্র লইয়া কাজ করিতেছে‌, টাইপরাইটারের খটখটি শব্দ হইতেছে‌, দর্শনীয় কিছু নাই। ঘুরিয়া ফিরিয়া শেষে আমরা সুরপতিবাবুর অফিসে বসিলাম।

সাধারণভাবে কিছুক্ষণ বাক্যালাপ চালাইবার পর ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে বলি‌, আমরা দুই বন্ধু মিলে একটা ছোটখাটো কয়লাখনি কেনবার মতলব করেছি। এখানে নয়‌, অন্য জেলায়। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কি করে কয়লাখনি চালাতে হয় আমরা কিছুই জানি না; তাই মণীশবাবুর খনি দেখতে এসেছি। অফিসের কাজ‌, খনির কাজ‌, সব বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই।’

সুরপতিবাবু মহা উৎসাহে বলিলেন‌, ‘নিশ্চয়‌, নিশ্চয়। এ আর বেশি কথা কি? অফিসের কাজ দুদিনে শিখে যাবেন; আর খনির কাজও এমন কিছু শক্ত নয়। তাছাড়া যদি দরকার হয় আমি আপনাকে খুব ভাল লোক দিতে পারি।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি রকম লোক?’

সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘অফিসের কাজ জানে‌, কোলিয়ারির কাজ জানে এমন লোক। আমার নিজের হাতে তৈরি করা লোক।’‌

ব্যোমকেশ আগ্রহ দেখাইয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি! তা কাজ-জোনা ভাল লোক পেলে আমরা নেব। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা হবে। অফিসের কাজকর্মও দেখব। আমরা এখন কিছুদিন আছি।’

অফিস হইতে ফিরিয়া আসিলাম।

বারোটার সময় ফণীশ ও মণীশবাবু খনি হইতে ফিরিলেন। স্নানাহার সারিতে একটা বাজিয়া গেল। তারপর খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়া আমরা চারজন মোটরে চড়িয়া কয়লাখনিতে চলিলাম।

মস্ত বড় মোটর। ফণীশ চালাইয়া লইয়া চলিল‌, আমরা তিনজন পিছনে বসিলাম।

মোটর শহর ছাড়াইয়া নির্জন রাস্তা ধরিল। মাইল তিনেক দূরে কয়লাখনি।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সকলে সুরপতিবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। উনি কতদিন আপনার কাজ করছেন?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘প্রায় কুড়ি বছর। পাকা লোক।’

ব্যোমকেশ কহিল‌, ‘ওঁকে বলেছি আমরা একটা কয়লাখনি কিনব। তাই খোঁজ খবর নিতে এসেছি। আমাদের সত্যিকার পরিচয় দিইনি।’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘ভালই করেছেন। সুরপতি। অবশ্য বিশ্বাসী লোক‌, দোষের মধ্যে বছর দুই আগে দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করেছে।’

সুরপতিবাবুর চুলের কলপ এবং শৌখিন জাম-কাপড়ের অর্থ পাওয়া গেল। প্রৌঢ় বয়সে তরুণী ভাৰ্য্যর চোখে যৌবনের বিভ্বম সৃষ্টি করার চেষ্টা স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সম্প্রতি কেউ আপনার খনি কেনবার প্রস্তাব করেছিল?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘সম্প্রতি নয়‌, কয়েক বছর আগে। একজন মাড়োয়ারী। ভাল দাম দিতে চেয়েছিল‌, আমি বেচিনি।’

ব্যোমকেশ দ্বিতীয় প্রশ্ন করিল‌, ‘এখানে অন্য যেসব খনির মালিক আছেন তাঁদের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব আছে?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘গাঢ় প্রণয় আছে এমন কথা বলতে পারি না‌, তবে মুখোমুখি ঝগড়া কারুর সঙ্গে নেই।’

‘এমন কেউ আছেন যিনি বাইরে ভদ্রতার মুখোশ পরে ভিতরে ভিতরে আপনার অনিষ্ট চিন্তা করছেন?’

‘থাকতে পারে‌, কিন্তু তাকে চিনিব কি করে?’

‘তা বটে। কাল রাত্রে যিনি এসেছিলেন-গোবিন্দ হালদার-তিনি কি রকম লোক?’

মণীশবাবু চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘গোবিন্দ হালদারকে চেনা শক্ত। পাঁকাল মাছের মত চরিত্র‌, ধরা-ছোঁয়া যায় না। তবে গোবিন্দবাবুর ছোট ভাই এবং অংশীদার অরবিন্দ অতি বদ লোক। মাতাল‌, জুয়াড়ী্‌্‌, দুশ্চরিত্র। বছর কয়েক আগে স্ত্রীটা আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছে। তারপর থেকে অরবিন্দ একেবারে নামকটা সেপাই হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

আর কোনও কথা হইল না‌, আমরা কয়লাখনির এলাকায় প্রবেশ করিলাম।

কয়লাখনির বিস্তারিত বর্ণনা দিবার ইচ্ছা নাই। যাঁহারা স্বচক্ষে কয়লাখনি দেখেন নাই তাঁহারা নিশ্চয় রঙ্গমঞ্চে বা চিত্রপটে দেখিয়াছেন‌, এমন কিছু নয়নাভিরাম দৃশ্য নয়। বিশেষত এই কাহিনীতে কয়লাখনির স্থান খুবই অল্প; কয়লাখনিকে এই কাহিনীর কালো পশ্চাৎপট বলাই সঙ্গত। পশ্চাৎপট না থাকিলে কাহিনী উলঙ্গ হইয়া পড়ে‌, তাই রাখিতে হইয়াছে।

কয়লা! যাহার জোরে যন্ত্র চলিতেছে তাহাকে যন্ত্রের সাহায্যে মৃত্তিকার গভীর গর্ভ হইতে টানিয়া আনা হইতেছে; সভ্যতার চাকা ঘুরিতেছে। নমো যন্ত্র। তব খনি-খনিত্র নখ-বিদীর্ণ ক্ষিতি বিকীর্ণ অস্ত্র! নমো যন্ত্র। অলমিতি।

খনির ম্যানেজার তারাপদবাবুর সঙ্গে পরিচয় হইল। বয়স্ক লোক‌, খনির সীমানার মধ্যে তাঁহার বাসস্থান; রাশভারী জবরদস্ত লোক বলিয়া মনে হয়। তিনি আমাদের লইয়া খনির বিভিন্ন অংশের কার্যকলাপ দেখাইলেন। খনির গর্ভে অবতরণ করিবার প্রস্তাবও করিয়াছিলেন‌, কিন্তু আমরা রাজী হইলাম না। সীতা পাতাল প্রবেশ করিয়াছিলেন তাহার যথেষ্ট কারণ ছিল; আমাদের সেরাপ কোনও কারণ নাই।

0 Shares