অপরাহ্নে আমরা তারাপদবাবুর অফিসে চা খাইলাম। সেখানে খনির ডাক্তার যতীন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্য উচ্চ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হইল। কাজের কথা কিছু হইল না, সাধারণভাবে আলাপ-আলোচনা চলিতে লাগিল। বলা বাহুল্য, আমরা ছদ্মনামেই রহিলাম। এক সময় লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশ ডাক্তার ঘোষের সঙ্গে বেশ ভাব জমাইয়া ফেলিয়াছে, ঘরের এক কোণে বসিয়া নিবিষ্ট মনে তাঁহার সহিত গল্প করিতেছে। ডাক্তার ঘোষ আমাদের সমবয়স্ক্্, তিনিও খনিতেই ডাক্তারখানা ও হাসপাতাল লইয়া থাকেন। তাঁহার কোট-প্যান্টুলুন-পরা চেহারায় জীবন-ক্লান্তির একটু আভাস পাওয়া যায়।
তারপর সন্ধ্যা হইলে আমরা আবার মোটরে চড়িয়া বাড়ির দিকে যাত্ৰা করিলাম।
রাত্রে আহারাদির পর মণীশবাবু উপরে শয়ন করিতে গেলেন, আমরা নিজের ঘরে আসিলাম। ফণীশ আমাদের সঙ্গে আসিল।
ব্যোমকেশ পাখা চালাইয়া দিয়া নিজের শয্যায় লম্বা হইল, সিগারেট ধরাইয়া ফণীশকে বলিল, ‘বোসো। কী কাণ্ড বাধিয়েছ? বৌমাকে এত উদ্বিগ্ন করে তুলেছ কেন?’
ফণীশ চেয়ারে বসিয়া হাত কচুলাইতে লাগিল, তারপর কুষ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘ইন্দিরাকে রাজী করিয়েছিলাম। আপনাকে বলতে, নিজে বলতে সাহস হয়নি—’
‘কিন্তু কথাটা কী? তোমাদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ভারি গুরুতর ব্যাপার।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, গুরুতর ব্যাপার। একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছি ঘটনাচক্ৰে। বাবা যদি জানতে পারেন–’
ব্যোমকেশ বিছানায় উঠিয়া বসিল, ‘খুনের মামলা।’
ফণীশ শীর্ণকণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে, বিশ্ৰী ব্যাপার। পুলিস তদন্ত শুরু করেছে, তারা জানতে পেরেছে যে আমরা–
‘কি হয়েছিল সব কথা গুছিয়ে বল।’
ফণীশ অবশ্য সব কথা গুছাইয়া বলিতে পারিল না। তাহার জেট-পাকানো কাহিনীকে আমি যথাসম্ভব সিধা করিয়া লিখিতেছি।–
এই শহরে একটি ক্লাব আছে। কৌতুকবশে তাহার নামকরণ হইয়াছো-কয়লা ক্লাব। ক্লাবের চাঁদার হার খুব উচু, তাই বড় মানুষ ছাড়া অন্য কেহ ইহার সভ্য হইতে পারে না। ফণীশ এই ক্লাবের সভ্য। আরও অনেক গণ্যমান্য সভ্য আছে; তন্মধ্যে উলুডাঙ্গা কয়লাখনির মালিক মৃগেন্দ্ব মৌলিক, ধুবিপোতা খনির মধুময় সুর এবং শিমুলিয়া খনির অরবিন্দ ও গোবিন্দ হালদার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ক্লাবে অপরাহ্নে টেনিস খেলা, ব্যাডমিণ্টন খেলা হয়; সন্ধ্যার পর বিলিয়ার্ড্্, পিংপং, তাস-পাশা চলে। বাজি রাখিয়া তাস খেলা হয়। কিন্তু ক্লাবের নিয়মানুযায়ী বেশি টাকা বাজি রাখা যায় না; তাই যাহাদের রক্তে জুয়ার নেশা আছে তাহাদের মন ভরে না। অরবিন্দ হালদার এই অতৃপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। কিন্তু উপায় কি? শহরে ভদ্রভাবে জুয়া খেলার অন্য কোনও আস্তানা নাই।
বছরখানেক আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ক্লাবের সভ্য হইয়াছিলেন। পয়সাওয়ালা লোক, মহাজনী কারবার খুলিয়াছিলেন, শহরে নবাগত। বাজার অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র অফিস আছে, কিন্তু থাকেন শহরের বাহিরে নির্জন রাস্তার ধারে এক বাড়িতে। শকুনি-মার্কা চেহারা, নাম প্রাণহারি পোদ্দার।
পোদ্দার মহাশয় ক্লাবে আসিয়া বসিয়া থাকেন। তাঁহার সমবয়স্ক বৃদ্ধ ক্লাবে কেহ নাই, বেশির ভাগই ছেলে-ছোকরা, দুচারজন মধ্যবয়স্ক আছেন। ক্রমে দু’একজনের সঙ্গে পরিচয় হইল। কিন্তু বয়সের পার্থক্যবশত কাহারও সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠত হইল না।
ফণীশ, মৃগেন মৌলিক, মধুময় সুর এবং অরবিন্দ হালদার এই চারজন মিলিয়া ক্লাবে একটি গোষ্ঠী রচনা করিয়াছিল। ফণীশ ছিল এই চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে ছোট, আর অরবিন্দ হলুদ ছিল সবচেয়ে বয়সে বড়। তাহার বয়স আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ; দলের মধ্যে সে-ই ছিল অগ্রণী।
একদিন সন্ধ্যার পর ইহারা ক্লাবের একটা ঘরে বসিয়া ব্রিজ খেলিতেছিল, পোদ্দার মহাশয় আসিয়া তাহাদের খেলা দেখিতে লাগিলেন। টেবিলের চারিপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কে কেমন হাত পাইয়াছে দেখিলেন। অরবিন্দ অলসকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কন্ট্রাক্ট ব্রিজ জানেন?’
বৃদ্ধ একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘জানি।’
‘খেলবেন?’
‘খেলব। কি রকম বাজি?’
‘এক টাকা পয়েণ্ট। চলবে?
‘চলবে।’
যে রাবার খেলা হইতেছিল তাহা শেষ হইলে তাস কাটিয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন বাহির হইয়া গেল। প্ৰাণহরি পোদ্দার খেলিতে বসিলেন।
দেখা গেল পোদ্দার মহাশয় অতি নিপুণ খেলোয়াড়। কিন্তু সেদিন তাঁহার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না, ভাল হাত পাইলেন না। খেলার শেষে হিসাব করিয়া দেখা গেল। তিনি একুশ টাকা হরিয়াছেন। তিনি টাকা শোধ করিয়া দিলেন।
তারপর হইতে প্ৰাণহারিবাবু প্ৰায় প্রত্যহই ফণীশদের দলে খেলিতে বসেন। কখনও হারেন, কখনও জেতেন; সকল অবস্থাতেই তিনি নির্বিকার। এইভাবে তিনি ফণীশদের দলের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেলেন।
কয়েকমাস। এইভাবে কাটিল।
গত ফান্ধুন মাসে একদিন খেলিতে বসিয়া প্ৰাণহারিবাবু বলিলেন, ‘আপনারা ব্রিজ ছাড়া অন্য কোনো খেলা খেলেন না?’
মধুময় সুর প্রশ্ন করিল, ‘কি রকম খেলা?’
প্ৰাণহরি বলিলেন, ‘এই ধরুন, পোকার কিংবা রানিং ফ্লাশ।’
মৃগেন মৌলিক বলিল, ‘আমরা সব খেলাই খেলতে জানি। কিন্তু ক্লাবে জুয়া খেলার নিয়ম নেই। ব্রিজ তো আর জুয়া নয়, game of skill.’ বলিয়া নাকের মধ্যে ব্যঙ্গ-হাস্য করিল।
প্রাণহরি তখন কিছু বলিলেন না। খেলা শেষ হইলে বলিলেন, ‘একদিন আসুন না। আমার বাসায়, নতুন খেলা খেলবেন।’
কাহারও আপত্তি হইল না। অরবিন্দ বলিল, ‘মন্দ কি। আপনি কোথায় থাকেন?’
প্রাণহরি বলিলেন, ‘শহরের বাইরে উলুডাঙা খনির রাস্তায় আমার বাসা। একলা থাকি, আপনারা যদি আসেন বেশ জমজমাট হবে। কালই আসুন না।’