সকলে রাজী হইল। প্ৰাণহারি ট্যাক্সি ধরিয়া চলিয়া গেলেন। তাঁহার নিজের গাড়ি নাই, ট্যাক্সির সহিত বাঁধা ব্যবস্থা আছে, ট্যাক্সিতেই যাতায়াত করেন।
পরদিন সন্ধ্যার পর চারজন অরবিন্দের মোটরে চড়িয়া প্রাণহোরর গৃহে উপস্থিত হইল। শহরের সীমানা হইতে মাইল দেড়েক দূরে নির্জন রাস্তার উপর দোতলা বাড়ি, আশেপাশে দু-তিনশত গজের মধ্যে অন্য বাড়ি নাই।
প্ৰাণহারিবাবু পরম সমাদরের সহিত তাহাদের অভ্যর্থনা করিলেন, নীচের তলার একটি সুসজ্জিত ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। কিছুক্ষণ সাধারণভাবে বাক্যালাপ হইল। প্রাণহারিবাবু
বিপত্নীক ও নিঃসন্তান; পূর্বে তিনি উড়িষ্যার কটক শহরে থাকিতেন। কিন্তু সেখানে মন টিকিল না। তাই এখানে চলিয়া আসিয়াছেন। সঙ্গে একটি দাসী আছে, সেই তাঁহার রন্ধন ও পরিচর্যা করে।
এই সময় দাসী চায়ের ট্রে হাতে লইয়া প্রবেশ করিল, ট্রে টেবিলের উপর নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল, আবার এক থালা কাটলেট লইয়া ফিরিয়া আসিল। দিব্য-গঠন যুবতী। বয়স কুড়ি-বাইশ; রং ময়লা, কিন্তু মুখখানি সুন্দর, হরিণের মত চোখ দু’টিতে কুহক ভরা। দেখিলে বিপ্ন-চাকরানী শ্রেণীর মেয়ে বলিয়া মনে হয় না। সে অতিথিদের মধ্যে কাহারও কাহারও মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল।
গরম গরম কাটলেট সহযোগে চা পান করিতে করিতে অরবিন্দ বলিল, ‘খাসা কাটলেট ভেজেছে। এটি আপনার ঝি?’
প্রাণহারিবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ। মোহিনীকে উড়িষ্যা থেকে এনেছি। রান্না ভাল করে।’
পানাহারের পর খেলা বসিল। সর্বসম্মতিক্রমে তিন তাসের খেলা রানিং ফ্লাশ আরম্ভ হইল। সকলেই বেশি করিয়া টাকা আনিয়াছিল, প্রাণহরিবাবু পাঁচশো টাকা লইয়া দেখিতে বসিলেন।
দুই ঘণ্টা খেলা হইল। বেশি হার-জিত কিন্তু হইল না; কেহ পঞ্চাশ টাকা জিতিল, কেহ। একশো টাকা হারিল। প্রাণহারিবাবু মোটের উপর হারিয়া রহিলেন। স্থির হইল তিন দিন পরে আবার এখানে খেলা বসিবে।
ফণীশের মনে কিন্তু সুখ নাই। সে তাঁস খেলিতে ভালবাসে বটে, কিন্তু জুয়াড়ী নয়। তাহার মাথার উপর কড়া প্রকৃতির বাপ আছেন, টাকাকড়ি সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। দলে পড়িয়া তাহাকে এই জুয়ার ব্যাপারে জড়াইয়া পড়িতে হইয়াছে, কিন্তু দল ছাড়িবার চেষ্টা করিলে তাহাকে হাস্যাম্পদ হইতে হইবে। ফণীশ নিতান্ত অনিচ্ছাভরে জুয়ার দলে সংযুক্ত হইয়া রহিল।
দ্বিতীয় দিন খেলা খুব জমিয়া গেল। মোহিনী মুগীর ফ্রাই তৈরি করিয়াছিল। চা সহযোগে তাহাই খাইতে খাইতে খেলা আরম্ভ হইল; তারপর মধ্যপথে প্ৰাণহারিবাবু বিলাতি হুইস্কির একটি বোতল বাহির করিলেন। ফণীশের মদ সহ্য হয় না, খাইলেই বমি আসে, সে খাইল না। অন্য সকলে খাইল। অরবিন্দ সবচেয়ে বেশি খাইল। খেলার বাজি উত্তরোত্তর চড়িতে লাগিল। সকলেই উত্তেজিত, কেবল প্রাণহারিবাবু নির্বিকার।
খেলার শেষে হিসাব হইল; অরবিন্দ প্রায় হাজার টাকা জিতিয়াছে, আর সকলে হারিয়াছে। প্রাণহারিবাবু দুইশত টাকা জিতিয়াছেন।
অতঃপর প্রতি হগুপ্তায় একদিন-দুইদিন খেলা বসে। খেলায় কোনও দিন একজন হারে, কোনও দিন অন্য কেহ হারে, বাকি সকলে জেতে। প্রাণহারিবাবু কোনও দিনই বেশি হারেন না, মোটের উপর লাভ থাকে।
খেলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি পার্শ্বাভিনয় আরম্ভ হইয়াছিল; তাহা মোহিনীকে লইয়া। মধুময় এবং মৃগেন্দ্ব হয়তো ভিতরে ভিতরে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু অরবিন্দ একেবারে নির্লজ্জভাবে তাহার পিছনে লাগিল। খেলার দিন সে সকলের আগে প্ৰাণহারিবাবুর বাড়িতে যাইত এবং রান্নাঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া মোহিনীর সহিত রসালাপ করিত। এমন কি দিনের বেলা প্রাণহরিবাবুর অনুপস্থিতি কালে সে তাঁহার বাড়িতে যাইত এরূপ অনুমানও করা যাইতে পারে। মোহিনীর সহিত অরবিন্দের ঘনিষ্ঠতা কতদূর হইয়াছিল। বলা যায় না, তবে মোহিনী যে স্তরের মেয়ে তাহাতে সে বড়মানুষের কৃপাদৃষ্টি উপেক্ষা করিবে এরূপ মনে করিবার কারণ নাই।
যাহোক, এইভাবে পাঁচ-ছয় হগুপ্ত কাটিল। ফণীশের মনে শান্তি নাই, সে বন্ধুদের এড়াইবার চেষ্টা করে। কিন্তু এড়াইতে পারে না; অরবিন্দ তাহাকে ধরিয়া লইয়া যায়। তারপর একদিন সকলের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত হইল। তাহারা জানিতে পারিল প্রাণহরিবাবু পাকা জুয়াচোর, তাক সুপ্রিয় মৃত সাফাই করেন। খুব খানিকটা বাচসা হইল, তারপর অতিথিরা খেলা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল।
হিসাবে জানা গেল অতিথিরা প্রত্যেকেই তিন-চার হাজার টাকা হারিয়াছে এবং সব টাকাই প্ৰাণহারির গর্ভে গিয়াছে। সবচেয়ে বেশি হারিয়াছে অরবিন্দ; প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
অরবিন্দ ক্লাবে বসিয়া আফসাইতে লাগিল, ‘আসুক না হাড়গিলে বুড়ো্্, ঠেঙিয়ে হাড় গুড়ো করব।’ মধুময়, মৃগেন্দ্র মুখে কিছু বলিল না, কিন্তু তাহাদের ভাবভঙ্গী দেখিয়া মনে হইল। প্ৰাণহারিকে হাতে পাইলে তাহারাও ছাড়িয়া দিবে না।
প্রাণহারিবাবু কিন্তু হুঁশিয়ার লোক, তিনি আর ক্লাবে মাথা গলইলেন না।
দিন সাতেক পরে অরবিন্দ বলিল, ‘ব্যাটা গা-ঢাকা দিয়েছে। চল, ওর বাড়িতে গিয়ে উত্তম-মধ্যম দিয়ে আসি।’
ফণীশ আপত্তি করিল, ‘কি দরকার। টাকা যা যাবার সে তো গেছেই—’
অরবিন্দ বলিল, ‘টাকা আমাদের হাতের ময়লা। কিন্তু ব্যাটা ঠকিয়ে দিয়ে যাবে? তুমি কি বলে মৃগেন?’
মৃগেন বলিল, ‘শিক্ষা দেওয়া দরকার।’
মধুময় বলিল, ‘ওর বাড়িতে একটা মেয়েলোক ছাড়া আর কেউ থাকে না, ভয়ের কিছু নেই।’