ব্যোমকেশ লিখিতে লিখিতে বলিল, ‘বিরহ নয়-বিকাশ।’
‘বিকাশ।’
‘বিকাশ দত্ত।’
‘ও–বিকাশ। তাকে চিঠি লিখছ কেন?’
‘বিকাশের জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করেছি। কয়লাখনির ডাক্তারখানায় আদলির চাকরি। তাই তাকে আসতে লিখছি।’
‘বুঝেছি।’
ব্যোমকেশ আবার চিঠি লেখায় মন দিল। সে বিকাশকে আনিয়া কয়লাখনিতে বসাইতে চায়, নিজে দূরে থাকিয়া কয়লাখনির তত্ত্ব সংগ্রহ করিবে। আপনি রইলেন ডরপানিতে পোলারে পাঠাইলেন চর।
প্রাতরাশের সময় লক্ষ্য করিলাম আজ ইন্দিরার মুখ অনেকটা প্রফুল্ল; দ্বিধা সংশয়ের মেঘ ফুড়িয়া সূর্যের আলো ঝিকমিক করিতেছে। ফণীশ তাহাকে বোমকেশের আশ্বাসের কথা বলিয়াছে।
আজও আমরা দু’জনে প্রাতরাশ গ্রহণ করিতেছি, দুই কত বহু পূর্বেই কর্মস্থলে চলিয়া গিয়াছেন। ব্যোমকেশ টেস্ট চিবাইতে চিবাইতে ইন্দিরার প্রতি কটাক্ষপাত করিল, বলিল, ‘তোমার কতটি একেবারে ছেলেমানুষ।’
ইন্দিরা লজ্জিতভাবে চক্ষু নত করিল; তারপর তাহার চোখে আবার উদ্বেগ ও শঙ্কা ফিরিয়া আসিল। এই মেয়েটির মনে স্বামী সম্বন্ধে আশঙ্কার অন্ত নাই; ব্যোমকেশ তাহাকে ভরসা দিয়া বলিল, ‘ভাবনা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা এখন বেরুচ্ছি।’
ইন্দিরা চোখ তুলিয়া বলিল, ‘কোথায় যাকেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই এদিক ওদিক। ফিরতে বোধ হয় দুপুর হবে। কর্তা যদি জিগ্যোস করেন, বোলো শহর দেখতে বেরিয়েছি।’
যাহার শেষ হইলে আমরা উঠিলাম। মোটর-ড্রাইভার আসিয়া জানাইল, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি।
গাড়িতে উঠিয়া ব্যোমকেশ ড্রাইভারকে হুকুম দিল, আগে পোস্ট-অফিসে চল।’
পোস্ট-অফিসে গিয়া চিঠিখানাতে এক্সপ্রেস ডেলিভারি টিকিট সাঁটিয়া ডাকে দিল, তারপর ফিরিয়া আসিয়া ড্রাইভারকে বলিল, ‘এবার থানায় চল। সদর থানা।’
থানার সিংহদ্বারে কনস্টেবলের পাহারা। ব্যোমকেশ বড় দারোগাবাবুর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলে সে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া বলিল, ‘নাম আর দরকার লিখে দিন–এত্তালা পাঠাচ্ছি।’
ব্যোমকেশ কাগজে লিখিল, ‘গগন মিত্র। মণীশ চক্রবর্তীর কয়লাখনি সম্পর্কে।’
অল্পক্ষণ পরে কনস্টেবল ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আসুন।’
ভিতরের একটি ঘরে ইউনিফর্ম-পরা দারোগাবাবু টেবিলের সামনে বসিয়া আছেন, আমরা প্রবেশ করিলে মুখ তুলিলেন, তারপর লাফাইয়া আসিয়া ব্যোমকেশের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘এ কি কাণ্ড! আপনি গগন মিত্র হলেন কবে থেকে।’
গলার স্বর শুনিয়া চিনিতে পারিলাম-প্রমোদ বরাট। কয়েক বছর আগে গোলাপ কলোনী সম্পর্কে কিছুদিনের জন্য ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। পুলিশের চাকরি ভবঘুরের চাকরি, তিনি ঘুরিতে ঘুরিতে এই শহরের সদর থানার দারোগাবাবু হইয়া আসিয়াছেন। নিকষকৃষ্ণ চেহারা এই কয় বছরে একটু ভারী হইয়াছে; মুখের ধার কিন্তু লেশমাত্র ভোঁতা হয় নাই।
সমাদর করিয়া আমাদের বসাইলেন। কিছুক্ষণ অতীত-চর্বণ চলিল, তারপর ব্যোমকেশ আমাদের এই শহরে আসার কারণ বলিল। শুনিয়া প্রমোদবাবু বলিলেন, ‘হঁ, ফুলঝুরি কয়লাখনির কেসটা আমাদের ফাইলে আছে, কিন্তু কিছু করা গেল না। এসব কাজ পুলিসের দ্বারা ভাল হয় না; আমাদের অনেক লোক নিয়ে কাজ করতে হয়, মন্ত্রগুপ্তি থাকে না। আপনি পারবেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিকাশ দত্তকে মনে আছে? তাকে ডেকে পাঠালাম, সে কয়লাখনিতে থেকে সুলুক-সন্ধান নেবে।’
প্রমোদবাবু বলিলেন, ‘বিকাশকে খুব মনে আছে। চৌকশ ছেলে। তা আমাকে দিয়ে যদি কোনো কাজ হয়—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার কাছে। ও-কাজের জন্যে আমি আসিনি, প্রমোদবাবু। সম্প্রতি এখানে একটা খুন হয়েছে, প্ৰাণহরি পোদ্দার নামে এক বৃদ্ধ—’
‘আপনি তার খবরও পেয়েছেন?’
‘না পেয়ে উপায় কি! আমরা যাঁর বাড়িতে অতিথি তাঁর ছেলেই তো আপনার একজন আসামী।’
প্রমোদ বরাট মুখের একটি করুণ ভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘বড় মুশকিলে পড়েছি, ব্যোমকেশবাবু। যে চারজনের ওপর সন্দেহ তারা সবাই এ শহরের হতকতা, প্রচণ্ড দাপট। তাই ভারি সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। সাক্ষী-সার্বুদ নেই, সবই circumstantial evidence, এদের কাউকে যদি ভুল করে গ্রেপ্তার করি, আমারই গর্দান যাবে।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘এই চারজনের মধ্যে কার ওপর আপনার সন্দেহ?’
প্রমোদবাবু ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, চারজনেরই মোটিভ সমান, চারজনেরই সুযোগ সমান। তবু মনে হয় এ অরবিন্দ হালদারের কাজ।’
‘চারজনে এক জোট হয়ে খুন করতে গিয়েছিল এমন মনে হয় না?’
‘না।’
‘বাড়িতে একটা দাসী ছিল, তার কথা ভেবে দেখেছেন?’
‘দেখেছি। তার সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি কিন্তু মোটিভ খুঁজে পাইনি।’
‘হুঁ। আপনি যা জানেন সব আমাকে বলুন, হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’
‘সাহায্য করবেন আপনি? ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, ব্যোমকেশবাবু।’
অতঃপর প্রমোদ বরাট যাহা বলিলেন তাহার মর্মার্থ এই—
যে-রাত্রে প্রাণহরি পোদ্দার মারা যান সে-রত্রে দশটার সময় উলুডাঙা কোলিয়ারির দিক হইতে একটা ট্রাক আসিতেছিল। ট্রাক-ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি থামাইল, কারণ একটা স্ত্রীলোক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া তাহাকে থামিতে বলিতেছে। গাড়ি থামিলে স্ত্রীলোকটা ছুটিয়া আসিয়া বলিল, শীগগির পুলিসে খবর দাও, এ বাড়ির মালিককে কারা খুন করেছে।’
ট্রাক-ড্রাইভার আসিয়া থানায় খবর দিল। আধঘণ্টার মধ্যে ইন্সপেক্টর বিরাট সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া অকুস্থলে উপস্থিত হইলেন। মেয়েটা তখনও ব্যাকুল চক্ষে রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার নাম মোহিনী, প্রাণহোরর গৃহে সেই একমাত্র দাসী, অন্য কোনও ভৃত্য নাই।