বরাট আগে আগে, আমরা তাঁহার পিছনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলাম। রান্নাঘরের দিক হইতে হেঁড়ে গলার আওয়াজ আসিতেছে। সেইদিকে অগ্রসর হইয়া দেখিলাম উর্দি-পরা পাহারাওলা গোঁফে চাড়া দিতে দিতে রান্নাঘরের দ্বারের সামনে দাঁড়াইয়া অন্তর্বর্তিনীর সহিত রসালাপ করিতেছে। আমাদের দেখিয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল।
বরাট আরক্ত চক্ষে তাহার পানে চাহিলেন, সে কলের পুতুলের মত স্যালুট করিল। বিরাট বলিলেন, ‘বাইরে যাও। সদর দরজা খোলা রেখে তুমি এখানে কি করছ?’
বরাটের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ আলঙ্কারিক। অতি বড় নিরেট ব্যক্তিও বুঝিতে পারে পাহারাওলা এখানে কি করিতেছিল। মক্ষিকা মধু ভাণ্ডের কাছে কী করে?
পাহারাওলা আবার স্যালুট করিয়া চলিয়া গেল। বরাট তখন রান্নাঘরের ভিতরে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। মোহিনী মেঝোয় বসিয়া তরকারি কুটিতেছিল, তুরিতে উঠিয়া বরাটের পানে সপ্রশ্ননেত্ৰে চাহিল।
কালো মেয়েটার সারা গায়ে-মুখে চোখে অঙ্গসঞ্চালনে-কুহকভরা ইন্দ্বজাল, ভরা যৌবনের দুৰ্নিবার আকর্ষণ। যদি রঙ ফরসা হইত। তাহাকে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলিত। তবু্, তাহার কালো রঙের মধ্যেও এমন একটি নিশীথ-শীতল মাদকতা আছে যে মনকে আবিষ্ট করিয়া ফেলে।
কিন্তু প্রমোদ বরাট কাঠখোট্টা মানুষ, তিনি বলিলেন, ‘তুমি তাজা তরকারি পেলে কোথায়?’
মোহিনী বলিল, ‘পাহারাওলাবাবু এনে দিয়েছেন। উনি নিজের সিধে তরিতরকারি আমাকে এনে দেন, আমি রোধে দিই। আমারও হয়ে যায়।’
বরাট গলার মধ্যে শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ , ভারি দয়ার শরীর দেখছি পাহারাওলাবাবুর।’
মোহিনী বক্রোক্তি বুঝিল কিনা বলা যায় না, প্রশ্ন করিল, ‘আমাকে কি দরকার আছে, দারোগাবাবু?’
প্রমোদবাবু বলিলেন, ‘তুমি এখানেই থাকো। আমরা খানিক পরে তোমাকে ডাকব।’
‘আচ্ছা।’
আমরা সদর দরজার দিকে ফিরিয়া চলিলাম। চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ স্মিতমুখে বলিল, ‘আপনি একটু ভুল করেছেন, ইন্সপেক্টর বরাট। আপনার উচিত ছিল একজন বুড়ো পাহারাওলাকে এখানে বসানো।’
বরাট বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনি ওদের চেনেন না। পাহারাওলারা যত বুড়ো হয় তাদের রস তত বাড়ে।’
ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘আর সুদখোর মহাজনেরা?’
বরাট চকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর নিম্নস্বরে বলিলেন, ‘সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না, ব্যোমকেশবাবু। কিন্তু পরিস্থিতি সন্দেহজনক। আপনি মেয়েটাকে জেরা করে দেখুন না, বুড়োর সঙ্গে ওর কোনো রকম ইয়ে ছিল। কিনা।’
‘দেখব।’ সদর দরজার পাশে উপরে উঠিবার সিঁড়ি দিয়া আমরা উপরে উঠিলাম। সিঁড়ির মাথায় মজবুত ভারী দরজা, তাহাতে ইয়েল-লক লাগানো। বাড়ির অন্যান্য দরজার তুলনায় এ দরজা নূতন বলিয়া মনে হয়। হয়তো প্রাণহরি পোদ্দার বাডি ভাড়া লইবার পর এই ঘরে নূতন দরজা লাগাইয়াছিলেন।
বরাট পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া দ্বার খুলিলেন। আমরা অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিলাম। তারপর বিরাট একটা জানোলা খুলিয়া দিতেই রৌদ্রোজ্জ্বল আলো ঘরে প্রবেশ করিল।
ঘরে দু’টি জানালা দু’টি দ্বার। একটি দ্বার সিঁড়ির মুখে, অন্যটি পিছনের দেয়ালে। ঘরটি লম্বায় চওড়ায় আন্দাজ পনেরো ফুট চৌকশ।। ঘরে আসবাব বিশেষ কিছু নাই; একটা তক্তপোশের উপর বিছানা, তাহার শিয়রের দিকে দেয়াল ঘোষিয়া একটি জগদ্দল লোহার সিন্দুক। একটা দেয়াল-আলনা হইতে প্ৰাণহারির ব্যবহৃত জামা কাপড় ঝুলিতেছে। প্রাণহারির টাকার অভাব ছিল না, কিন্তু জীবন যাপনের পদ্ধতি ছিল নিতান্ত মামুলী। মাথার কাছে লোহার সিন্দুক লইয়া দরজায় ইয়েল-লক লাগাইয়া তিনি তক্তপোশের মলিন শয্যায় শয়ন করিতেন।
ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু চক্ষু বুলাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘লাশ কোথায় ছিল?’
সিঁড়ির দরজা হইতে হাত চারেক দূরে মেঝের দিকে আঙুল দেখাইয়া বরাট বলিলেন, ‘এইখানে।’
ব্যোমকেশ নত হইয়া স্থানটা পরীক্ষা করিল, বলিল, ‘রিক্তের দাগ তো বিশেষ দেখছি না। সামান্য ছিটেফোঁটা।’
বরাট বলিলেন, ‘বুড়োর গায়ে কি রক্ত ছিল! চেহারাটা ছিল বেউড় বাঁশের মত।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অবশ্য মাথার খুলি ভাঙলে বেশি রক্তপাত হয় না।–মারণাস্ত্রটা পাওয়া গেছে?’
না। ঘরে কোন অস্ত্র ছিল না। বাড়িতেও এমন কিছু পাওয়া যায়নি যাকে মারণাস্ত্র মনে করা ঘোড় পারে। বাড়ির চারপাশে বহু দূর পর্যন্ত খুঁজে দেখা হয়েছে, মরনাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
‘যাক। সিন্দুক খুলে দেখেছিলেন নিশ্চয়। কি পেলেন?’
‘সিন্দুকের চাবি পোদ্দারের কোমরে ছিল। সিন্দুক খুলে পেলাম হিসেবের খেরো-বাঁধানো খাতা আর নগদ দশ হাজার টাকা।’
‘দশ হাজার টাকা।’
‘হ্যাঁ। বুড়োর মহাজনী কারবার ছিল তাই বোধহয় নগদ টাকা কাছে রাখতো।’
‘হুঁ। ব্যাঙ্কে টাকা ছিল?’
‘ছিল। এবং এখনো আছে। কে পাবে জানি না। টাকা কম নয়, প্ৰায় দেড় লাখ।’
‘তাই নাকি! আত্মীয়-স্বজনরা খবর পেয়েছে?’
‘বোধহয় কেউ নেই। থাকলে শকুনির পালের মত এসে জুটত।’
‘শহরে বুড়োর একটা অফিস ছিল শুনেছি। সেখানে তল্লাশ করে কিছু পেয়েছিলেন?’
‘অফিস মানে চোর-কুটুরির মত একটা ঘর।–দু’ চারটে খাতাপাত্তর ছিল, তা থেকে মনে হয় মহাজনী কারবার ভাল চলত না।’
ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে কতকটা নিজমনেই বলিল, ‘মহাজনী কারবার ভাল চলত না, অথচ ব্যাঙ্কে দেড় লাখ এবং সিন্দুকে দশ হাজার-চিন্তা হইতে জাগিয়া উঠিয়া সে বলিল, ‘ওই অন্য দরজাটার বাইরে কি আছে?’
বরাট বলিলেন, ‘স্নানের ঘর ইত্যাদি।’