রামেশ্বরবাবুর পরিবারিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অতি সংক্ষিপ্ত। কলিকাতার উত্তরাংশে নিজের একটি বাড়িতে থাকেন। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুমুদিনীর বয়স এখন বোধ করি পঞ্চাশোর্ধে্্, তিনি নিঃসন্তান। প্রথম পক্ষের পুত্রের নাম সম্ভবত রামেশ্বরবাবু নিজের নামের সহিত মিলাইয়া কুশেশ্বর রাখিয়াছিলেন। কুশেখরের বয়সও পঞ্চাশের কম নয়, মাথার কিয়দংশে পাকা চুল, কিয়দংশে টাকা। সে বিবাহিত, কিন্তু সন্তান-সন্ততি আছে কিনা বলিতে পারি না। তাহাকে দেখিলে মেরুদণ্ডহীন অসহায় গোছের মানুষ বলিয়া মনে হয়। তাহার কনিষ্ঠ ভগিনী নলিনী শুনিয়াছি প্রেমে পড়িয়া একজনকে বিবাহ করিয়াছিল, তাহার সহিত রামেশ্বরবাবুর কোনও সম্পর্ক নাই। মোট কথা তাঁহার পরিবার খুব বড় নয়, সুতরাং অশান্তির অবকাশ কম। তাঁহার অগাধ টাকা, প্ৰাণে অফুরন্তু হাস্যরস। তবু সন্দেহ হয় তাঁহার পারিবারিক জীবন সুখের নয়।
২
পরদিন বেলা ন’টার সময় রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম।
বাড়িটা সরু লম্বা গোছের; দ্বারের সামনে মোটর দাঁড়াইয়া আছে। আমরা বন্ধ দ্বারের কড়া নাড়িলাম।
অল্পক্ষণ পরে দ্বার খুললেন একটা মহিলা। তিনি বোধ হয়। অন্য কাহাকেও প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, তাই আমাদের দেখিয়া তাঁহার কলহোদ্যত প্রখর দৃষ্টি নরম হইল; মাথায় একটু আচল টানিয়া দিয়া তিনি পাশ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, মুদুকণ্ঠে বলিলেন, ‘কাকে চান?’
রামেশ্বরবাবুর বাড়ির দু’টি স্ত্রীলোকের সহিত আলাপ না থাকিলেও তাঁহাদের দেখিয়াছি। ইনি কুশেখরের স্ত্রী; দৃঢ়গঠিত বেঁটে মজবুত চেহারা, বয়স আন্দাজ চল্লিশ। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
মহিলার চোয়ালের হাড় শক্ত হইল; তিনি বোধ করি দ্বার হইতেই আমাদের বিদায় বাণী শুনাইবার জন্য মুখ খুলিয়াছিলেন, এমন সময় সিঁড়িতে জুতার শব্দ শোনা গেল। মহিলাটি একবার চোখ তুলিয়া সিঁড়ির দিকে চাহিলেন, তারপর দ্বার হইতে অপসৃত হইয়া পিছনের একটি ঘরে প্রবেশ করিলেন। ঘরটি নিশ্চয় রান্নাঘর, কারণ সেখান হইতে হাতা-বেড়ির শব্দ আসিতেছে।
সিঁড়ি দিয়া দু’টি লোক নামিয়া আসিলেন; একজন কুশেখর, দ্বিতীয় ব্যক্তি বিলাতি বেশধারী প্রবীণ ডাক্তার। দ্বারের দিকে অগ্রসর হইতে হইতে ডাক্তার বলিলেন, ‘উপস্থিত ভয়ের কিছু দেখছি না। যদি দরকার মনে কর, ফোন কোরো।’
ডাক্তার মোটরে গিয়া উঠিলেন, মোটর চলিয়া গেল। আমরা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছি, কুশেশ্বর এতক্ষণ তাহা লক্ষ্য করে নাই; এখন ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইল। তাহার টাক একটু বিস্তীর্ণ হইয়াছে অবশিষ্ট চুল আর একটু পাকিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাদের বোধ হয় চিনতে পারছেন না, আমি ব্যোমকেশ বক্সী। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
কুশেশ্বর বিহ্বল হইয়া বলিল, ‘ব্যোমকেশ বক্সী! ও-তা-হ্যাঁ, চিনেছি বৈকি। বাবার শরীর ভাল নয়—‘
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি হয়েছে?’ কুশেশ্বর বলিল, ‘কাল রাত্রে হঠাৎ হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। এখন সামলেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন? তা-তিনি তেতলার ঘরে আছেন–’
এই সময় রান্নাঘরের দিক হইতে উচ্চ ঠকঠক শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। কড়া আওয়াজ; আমরা তিনজনেই সেইদিকে তাকাইলাম; রান্নাঘরের ভিতর হইতে একটি অদৃশ্য হস্ত কপাটের উপর সাঁড়াশি দিয়া আঘাত করিতেছে। কুশেখরের দিকে চাহিয়া দেখি তাহার মুখের ভাব বদলাইয়া গিয়াছে। সে কাশিয়া গলা সাফ করিয়া বলিল, ‘বাবার সঙ্গে তো দেখা হতে পারে না, তাঁর শরীর খুব খারাপ-ডাক্তার এসেছিলেন–’
ওদিকে ঠকঠক শব্দ তখন থামিয়াছে। ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল, ‘বুঝেছি। ডাক্তারবাবুর নাম কি?’
কুশেশ্বর আবার উৎসাহিত হইয়া বলিল, ‘ডাক্তার অসীম সেন। চেনেন না? মস্ত হার্ট স্পেশালিস্ট।’
‘চিনি না, কিন্তু নাম জানি। বিবেকানন্দ রোডে ডিসপেন্সারি।’
‘হ্যাঁ’
‘তাহলে রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না?’
‘মানে-ডাক্তারের হুকুম নেই–কুশেশ্বর একবার আড়চোখে রান্নাঘরের পানে তাকাইল।
‘কত দিন থেকে ওঁর শরীর খারাপ যাচ্ছে?’
শরীর তো একরকম ভালই ছিল; তবে অনেক বয়স হয়েছে, বেশি নড়াচড়া করতে পারেন। না, নিজের ঘরেই থাকেন। কাল সকালে অনেকগুলো চিঠি লিখলেন, তারপর রাত্তিরে হঠাৎ–’
রান্নাঘরের দ্বারে অধীর সাঁড়াশির শব্দ হইল; কুশেশ্বর অর্ধপথে থামিয়া গেল। . ব্যোমকেশ বলিল, টরে-টক্কা! আপনার স্ত্রী বোধ হয় রাগ করছেন। — চললাম, নমস্কার।’
ফুটপাথে নামিয়া পিছন ফিরিয়া দেখি সদর দরজা বন্ধ হইয়া-গিয়াছে।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বিমানাভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, ‘ডাক্তার অসীম সেনের ডিসপেন্সারি বেশি দূর নয়। চল, তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই।’
ভাগ্যক্রমে ডাক্তার সেন ডিসপেন্সারিতে ছিলেন, তিন-চারটি রোগীও ছিল। ব্যোমকেশ চিরকুট নাম লিখিয়া পঠাইয়া দিল। ডাক্তার সেন বলিয়া পাঠাইলেন-একটু অপেক্ষা করিতে হইবে।
আধা ঘণ্টা পরে রোগীদের বিদায় করিয়া ডাক্তার সেন আমাদের ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমরা তাঁহার খাস কামরায় উপনীত হইলাম। ডাক্তারি যন্ত্রপাতি দিয়া সাজানো বড় ঘরের মাঝখানে বড় একটি টেবিলের সামনে ডাক্তার বসিয়া আছেন, ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনিই ব্যোমকেশবাবু? আজ রামেশ্বরবাবুর বাড়ির সদরে আপনাদের দেখেছি না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। আমরা কিন্তু হৃদযন্ত্র পরীক্ষা করাবার জন্য আসিনি, অন্য একটু কাজ আছে। আমার পরিচয়—‘