খুঁজি খুঁজি নারি

ডাক্তার সেন হাসিয়া বলিলেন‌, ‘পরিচয় দিতে হবে না। বসুন। কি দরকার বলুন।’

আমরা ডাক্তার সেনের মুখোমুখি বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। কাল তাঁর নববর্ষের শুভেচ্ছাপত্র পেলাম‌, তাতে তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। এমনি একটা সংশয় জানিয়েছিলেন; তাই আজ সকালে তাঁকে দেখতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম‌, রাত্রে তাঁর হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেলাম না‌, তাই আপনার কাছে এসেছি তাঁর খবর জানতে। আপনি কি রামেশ্বরবাবুর ফ্যামিলি ডাক্তার?’

ডাক্তার সেন বলিলেন‌, ‘পারিবারিক বন্ধু বলতে পারেন। ত্ৰিশ বছর ধরে আমি ওঁকে দেখছি। ওঁর হৃদযন্ত্র সবল নয়‌, বয়সও হয়েছে প্রচুর। মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প কষ্ট পাচ্ছিলেন; তারপর কাল হঠাৎ গুরুতর রকমের কন্নড়াবাড়ি হল। যাহোক‌, এখন সামলে গেছেন।’

‘উপস্থিত তাহলে মৃত্যুর আশঙ্কা নেই?’

‘তা বলতে পারি না। এ ধরনের রুগীর কথা কিছুই বলা যায় না; দু’ বছর বেঁচে থাকতে পারেন‌, আবার আজই দ্বিতীয় অ্যাটাক হতে পারে। তখন বাঁচা শক্ত।’

‘ডাক্তারবাবু্‌, আপনার কি মনে হয় রামেশ্বরবাবুর যথারীতি সেবা-শুশ্রূষা হচ্ছে?’

ডাক্তার কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন‌, শেষে ধীরে ধীরে বলিলেন‌, ‘আপনি যা ইঙ্গিত করছেন তা আমি বুঝেছি। এরকম ইঙ্গিতের সঙ্গত কারণ আছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি রামেশ্বরবাবুকেই চিনি‌, ওঁর পরিবারের অন্য কাউকে সেভাবে চিনি না। কিন্তু আজ দেখেশুনে আমার সন্দেহ হল‌, ওঁরা বাইরের লোককে রামেশ্বরবাবুর কাছে ঘেষতে দিতে চান না।’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘তা ঠিক। আপনি রামেশ্বরবাবুর ফ্যামিলিকে ভালভাবে চেনেন না। কিন্তু আমি চিনি। আশ্চর্য ফ্যামিলি। কারুর মাথার ঠিক নেই। রামেশ্বরবাবুর স্ত্রী কুমুদিনীর বয়স ষাট‌, অথর্ব মোটা হয়ে পড়েছেন; কিন্তু এখনো পুতুল নিয়ে খেলা করেন‌, সংসারের কিছু দেখেন না। কুশেশ্বরটা ক্যাবলা‌, স্ত্রীর কথায় ওঠেবসে। একমাত্র কুশেখরের স্ত্রী লাবণ্যর ইশ-পর্ব আছে‌, কাজেই অবস্থগতিকে সে সংসারের কর্ণধার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘কিন্তু বাড়িতে চাকর-বামুন নেই কেন?’

‘লাবণ্য চাকর-বাকর সহ্য করতে পারে না‌, তাই সবাইকে তাড়িয়েছে। নিজে রাঁধতে পারে না‌, শুধু এটা হাবা কালা বামনী রেখেছে বাকি সব কাজ নিজে করে। কুশেশ্বরকে বাজারে পাঠায়।‘

‘কিন্তু কেন? এসবের একটা মানে থাকা চাই তো।’

ডাক্তার চিন্তা করিয়া বলিলেন‌, ‘আমার বিশ্বাস‌, এসবের মূলে আছে নলিনী।’

‘নলিনী। রামেশ্বরবাবুর মেয়ে?’

‘হ্যাঁ। অনেক দিনের কথা‌, আপনি হয়তো শোনেননি। নলিনী বাড়ির সকলের মতের বিরুদ্ধে এক ছোকরাকে বিয়ে করেছিল‌, সেই থেকে তার ওপর সকলের আক্ৰোশ। সবচেয়ে বেশি। আক্রোশ লাবণ্যর। রামেশ্বরবাবু প্রথমটা খুবই চটেছিলেন‌, কিন্তু ক্রমে তাঁর রাগ পড়ে গেল। লাবণ্যর কিন্তু রাগ পড়ল না। সে নলিনীকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চায় না‌, বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। পাছে রামেশ্বরবাবু চাকর-ব্যাকরকে দিয়ে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাই তাদের সরিয়েছে। রামেশ্বরবাবু বলতে গেলে নিজের বাড়িতে নজরবন্দী হয়ে আছেন‌, কিন্তু তাঁর সেবাশুশ্রূষার কোন ক্রুটি হয় না।’

ব্যোমকেশ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল‌, ‘হঁ‌, পরিস্থিতি কতকটা বুঝতে পারছি। আচ্ছা‌, রামেশ্বরবাবু উইল করেছেন। কিনা। আপনি বলতে পারেন?’

ডাক্তার সেন সচকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, ‘করেছেন। আমার বিশ্বাস তিনি উইল করে নলিনীকে সম্পত্তির অংশ দিয়ে গেছেন। আমি জানতাম না‌, কাল রাত্রে জানতে পেরেছি।’

‘কি রকম?’

‘কাল রাত্রি দশটার সময় রামেশ্বরবাবুর হার্ট-অ্যাটাক হয়; আমাকে ফোন করল‌, আমি গেলাম। ঘন্টাখানেক পরে রামেশ্বরবাবু সামলে উঠলেন। তখন আমি সকলকে খেতে পাঠিয়ে দিলাম। রামেশ্বরবাবু চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকালেন‌, তারপর ফিসফিস করে বললেন‌, ‘ডাক্তার‌, আমি উইল করেছি। যদি পটল তুলি‌, নলিনীকে খবর দিও।’ এই সময়ে লাবণ্য আবার ঘরে ঢুকাল আর কোন কথা হল না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘স্পষ্টই বোঝা যায় ওরা রামেশ্বরবাবুকে উইল করতে দিচ্ছে না‌, পাছে তিনি নলিনীকে সম্পত্তির অংশ লিখে দেন। উনি যদি উইল না করে মারা যান তাহলে সাধারণ সুরক্সিকু নিয়মে ছেলে আর শ্ৰী সম্পত্তি পোব‌, মেয়ে কিছুই পাবে না—ব্রামেশ্বরবাবুরর বাঁধা উকিল কে?’

ডাক্তার সেন বলিলেন‌, ‘বাঁধা উকিল কেউ আছে বলে তো শুনিনি।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল‌, ‘আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ভাল কথা‌, নলিনীর সাংসারিক অবস্থা কেমন?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘নেহাত ছা-পোষা গোরস্ত। ওর স্বামী দেবনাথ সামান্য চাকরি করে‌, তিন-চারশো টাকা মাইনে পায়। কিন্তু অনেকগুলি ছেলেপুলে–’

অতঃপর আমরা ডাক্তার সেনকে নমস্কার জানাইয়া চলিয়া আসিলাম। রামেশ্বরবাবুর পারিবারিক জীবনের চিত্রটা আরও পূণাঙ্গ হইল বটে‌, কিন্তু আনন্দদায়ক হইল না। বৃদ্ধ হাস্যরসিক‌, অন্তিমকালে সত্যই বিপাকে পড়িয়াছেন‌, অথচ তাঁহাকে সাহায্য করিবার উপায় নাই। ঘরের টেকি যদি কুমীর হয়‌, সে কি করিতে পারে?

দিন আষ্টেক পরে একদিন দেখিলাম‌, সংবাদপত্রের পিছন দিকের পাতার এক কোণে রামেশ্বরবাবুর মৃত্যু-সংবাদ বাহির হইয়াছে। তিনি খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন না‌, কিন্তু তাঁহার টাকা ছিল‌, তাই বোধ হয় তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ দৈনিক পত্রের পৃষ্ঠা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে।

0 Shares