খুঁজি খুঁজি নারি

ব্যোমকেশ খবরের কাগজে কেবল বিজ্ঞাপন পড়ে‌, তাই তাহাকে খবরটা দেখাইলাম। আজ রমেশ্বরবাবুর নামোল্লেখে তাহার মুখে হাসি ফুটিল না‌, সে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর পাশের ঘরে গিয়া টেলিফোনে কাহার সহিত কথা বলিল।

সে ফিরিয়া আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কাকে?’

সে বলিল‌, ‘ডাক্তার অসীম সেনকে‌, পরশু রাত্রে রামেশ্বরবাবুর মৃত্যু হয়েছে। আবার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল‌, ডাক্তার সেন উপস্থিত ছিলেন; কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। ডাক্তার স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দিয়েছেন।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তোমার কি সন্দেহ ছিল যে-?’

সে বলিল‌, ‘ঠিক সন্দেহ নয়। তবে কি জানো‌, এ রকম অবস্থায় একটু অসাবধানত‌, একটু ইচ্ছাকৃত অবহেলা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রামেশ্বরবাবু মারা গেলে ওদের কারুরই লোকসান নেই‌, বরং সকলেরই লাভ। এখন কথা হচ্ছে‌, তিনি যদি উইল করে গিয়ে থাকেন এবং তাতে নলিনীকে ভাগ দিয়ে থাকেন‌, তাহলে সে-উইল কি ওরা রাখবে? পেলেই ছিঁড়ে ফেলে দেবে।’

সেদিন অপরাহ্নে নলিনী ও তাহার স্বামী দেবনাথ দেখা করিতে আসিল।

নলিনীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি; সন্তান-সৌভাগ্যের আধিক্যে শরীর কিছু কৃশ‌, কিন্তু যৌবনের অস্তলীলা দেহ হইতে সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। দেবনাথের বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ; এককালে সুশ্ৰী ছিল‌, হাত তুলিয়া আমাদের নমস্কার করিল।

নলিনী সজলচক্ষে বলিল‌, ‘বাবা মারা গেছেন। তাঁর শেষ আদেশ আপনার সঙ্গে যেন দেখা করি। তাই এসেছি।’

ব্যোমকেশ তাঁহাদের সমাদর করিয়া বসাইল। সকলে উপবিষ্ট হইলে বলিল‌, ‘রামেশ্বরবাবুর শেষ আদেশ কবে পেয়েছেন?’

নলিনী বলিল‌, ‘পয়লা বৈশাখ। এই দেখুন চিঠি।’

খামের উপর কলিকাতার অপেক্ষাকৃত দুর্গত অঞ্চলের ঠিকানা লেখা। চিঠিখানি ব্যোমকেশকে লিখিত চিঠির অনুরূপ সেই মনোগ্রাম করা কাগজ। চিঠি কিন্তু আরও সংক্ষিপ্ত—

কল্যাণীয়াষু্‌,

তোমরা সকলে আমার নববর্ষের আশীবাদ লইও। যদি ভালোমন্দ কিছু হয়‌, শ্ৰীযুক্ত ব্যোমকেশ বক্সী মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিও। ইতি—

শুভাকাঙ্খী

বাবা

পত্র রচনায় মুন্সিয়ানা লক্ষণীয়। কুশেশ্বর ও লাবণ্য যদি চিঠি খুলিয়া পড়িয়া থাকে‌, সন্দেহজনক কিছু পায় নাই। ‘ভালোমন্দ কিছু হয়-ইহার নিগূঢ় অর্থ যে নিজের মৃত্যু সম্ভাবনা তাহা সহসা ধরা যায় না‌, সাধারণ বিপদ-আপদও হইতে পারে। তাই তাহারা চিঠি আটকায় নাই।

চিঠি ফেরত দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শেষবার কবে রামেশ্বরবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?’

নলিনী বলিল‌, ‘ছ-মাস আগে। পুজোর পর বাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলুম‌, সেই শেষ দেখা। তা বৌদি। সারাক্ষণ কাছে দাঁড়িয়ে রইল‌, আড়ালে বাবার সঙ্গে একটা কথাও কইতে দিলে না।’

‘বৌদির সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই?’

‘সম্ভাব! বৌদি আমাকে পাশ পেড়ে কাটে।’

‘কোন কারণ আছে কি?’

‘কারণ আর কি! ননদ-ভাজ‌, এই কারণ। বৌদি বাঁজা‌, আমার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলেপুলে হয়েছে‌, এই কারণ।’

‘ডাক্তার সেনের সঙ্গে সম্প্রতি আপনাদের দেখা হয়েছে?

‘সেন-কাকা কাল সকালে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি বললেন‌, বাবা নাকি উইল করে গিয়েছেন।’

‘সেই উইল কোথায় আপনারা জানেন?’

‘কি করে জানিব? বাবাকে ওরা একরকম বন্দী করে রেখেছিল। বাবা অথর্ব হয়ে পড়েছিলেন‌, তোতলায় নিজের ঘর ছেড়ে বেরুতে পারতেন না; ওরা যক্ষির মত বাবাকে আগলে থাকত। বাবা যেসব চিঠি লিখতেন ওয়া খুলে দেখত‌, যে-চিঠি ওদের পছন্দ নয় তা ছিঁড়ে ফেলে দিত। বাবা যদি উইল করেও থাকেন তা কি আর আছে? বৌদি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, রামেশ্বরবাবু বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, তিনি যদি উইল করে গিয়ে থাকেন, নিশ্চয় এমন কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছেন যে সহজে কেউ খুঁজে পাবে না। এখন কাজ হচ্ছে ওরা সেটা খুঁজে পাবার আগে আমাদের খুঁজে বার করা।’

নলিনী সংগ্রহে বলিল‌, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু। বাবা যদি উইল করে থাকেন নিশ্চয় আমাদের কিছু দিয়ে গেছেন‌, নইলে উইল করার কোন মানে হয় না। কিন্তু এ অবস্থায় কি করতে হয় আমরা কিছুই জানি না–নলিনী কাতর নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে চাহিল।

এই সময় দেবনাথ গলা খাঁকারি দিয়া সর্বপ্রথম কিছু বলিবার উপক্রম করিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে একটু অপ্রতিভভাবে বলিল‌, ‘একটা কথা মনে হল। শুনেছি উইল করলে দু’জন সাক্ষীর দস্তখত দরকার হয়। কিন্তু আমার শ্বশুর দু’জন সাক্ষী কোথায় পাবেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার কথা যথার্থ; কিন্তু একটা ব্যতিক্রম আছে। যিনি উইল করেছেন তিনি যদি নিজের হাতে আগাগোড়া উইল লেখেন তাহলে সাক্ষীর দরকার হয় না।’

নলিনী উজ্জ্বল চোখে স্বামীর পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘শুনলে? এই জন্যে বাবা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।–ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি একটা উপায় করুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চেষ্টা করব। উইল বাড়িতেই আছে‌, বাড়ি সার্চ করতে হবে। কিন্তু ওরা যাকে-তাকে বাড়ি সার্চ করতে দেবে কেন? পুলিসের সাহায্য নিতে হবে। ডাক্তার অসীম সেনকেও দরকার হবে। দু-চার দিন সময় লাগবে। আপনারা বাড়ি যান‌, যা করবার আমি করছি। উইলের অস্তিত্র যদি থাকে‌, আমি খুঁজে বার করব।’

ব্যোমকেশ যখন সরকারী মহলে দেখাশুনা করিতে যাইত‌, আমাকে সঙ্গে লইত না। আমারও সরকারী অফিসের গোলকধাঁধায় ঘুরিয়া বেড়াইতে ভালো লাগিত না।

দুই দিন ব্যোমকেশ কোথায় কোথায় ঘুরিয়া বেড়াইল জানি না। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরিয়া সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল‌, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে।’

0 Shares