খুঁজি খুঁজি নারি

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কী ঠিক হয়ে গেছে?’

সে বলিল‌, ‘খানাতল্লাশের পরোয়ানা পাওয়া গেছে। কাল সকালে পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমরা রামেশ্বরবাবুর বাড়ি সার্চ করতে যাব।’

পরদিন সকালবেলা আমরা রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। সঙ্গে পাঁচ-ছয় জন পুলিসের লোক এবং ইন্সপেক্টর হালদার নামক জনৈক অফিসার।‌

কুশেশ্বর প্রথমটা একটু লম্ফঝাম্প করিল‌, তাহার স্ত্রী লাবণ্য আমাদের নয়ন।বহ্নিতে ভস্ম করিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না‌, ইন্সপেক্টর হালদার তাঁহাদের এবং বিধবা কুমুদিনীকে একজন পুলিসের জিম্মায় রান্নাঘরে বসাইয়া তল্লাশ আরম্ভ করিলেন। ত্রিতল বাড়ির কোনও তলই বাদ দেওয়া হইল না; দুইজন নীচের তলা তল্লাশ করিল‌, দুইজন দ্বিতলে কুশেশ্বর ও লাবণ্যর ঘরগুলি অনুসন্ধানের ভার লইল‌, ব্যোমকেশ‌, ইন্সপেক্টর হালদার ও আমি তিনতলায় : রামেশ্বরবাবু তিনতলায় থাকিতেন‌, সুতরাং সেখানেই উইল পাওয়া যাইবার সম্ভাবনা বেশি।

দুইটি ঘর লইয়া তিনতলা। ছোট ঘরটি গৃহিণীর শয়নকক্ষ‌, বড় ঘরটি একাধারে রামেশ্বরবাবুর শয়নকক্ষ এবং অফিস-ঘর। এক পাশে ‘তাঁহাদের শয়নের পালঙ্ক‌, অন্য পাশে টেবিল চেয়ার বইয়ের আলমারি প্রভৃতি। এই ঘর হইতে একটি সরু দরজা দিয়া স্নানের ঘরে যাইবার রাস্তা।

আমরা তল্লাশ আরম্ভ করিলাম। তল্লাশের বিস্তারিত ব্বিরণ প্রয়োজন নাই। দুইটি ঘরের বহু আসবাব‌, খাট বিছানা টেবিল চেয়ার আলমারির ভিতর হইতে এক টুকরা কাগজ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে‌, সুতরাং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই তল্লাশ করা হইল। তল্লাশ করিতে করিতে একটি তথ্য আবিষ্কার করিলাম; আমাদের পূর্বে আর একদফা তল্লাশ হইয়া গিয়াছে। কুশেশ্বর এবং তাহার স্ত্রী উইলের খোঁজ করিয়াছে।

ব্যোমকেশ আমার কথা শুনিয়া বলিল‌, ‘হুঁ। এখন কথা হচ্ছে ওরা খুঁজে পেয়েছে কিনা।’

আড়াই ঘণ্টা পরে আমরা ক্লান্তভাবে টেবিলের কাছে আসিয়া বসিলাম। টেবিলের এক পাশে একটি পিতলের ছোট্ট হামানদিস্তা ছিল‌, রামেশ্বরবাবু তাহাতে পান ছেঁচিয়া খাইতেন; ব্যোমকেশবাবু সেটা সামনে টানিয়া আনিয়া অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। ইতিপূর্বে, নিম্নতলে যাহারা তল্লাশ করিতেছিল তাহারা জানাইয়া গিয়াছে যে সেখানে কিছু পাওয়া যায় নাই।

ইন্সপেক্টর হালদার বলিল‌, ‘তেতলায় নেই। তার মানে রামেশ্বরবাবু উইল করেননি‌, কিংবা ওরা আগেই উইল খুঁজে পেয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উইল করা সম্বন্ধে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু—‘

এই সময় ইন্সপেক্টর হালদার অলস। হস্তে গঁদের শিশির ঢাকনা তুলিলেন।

টেবিলের উপর কাগজ কলম লেফাফা পিন-কুশন গঁদের শিশি প্রভৃতি সাজানো ছিল‌, আমরা পূবইে টেবিল ও তাহার দেরাজগুলি খুঁজিয়া দেখিয়াছি‌, কিন্তু গঁদের শিশির ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসিয়া লাগিল।

কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ!

ব্যোমকেশ খাড়া হইয়া বসিল‌, ‘কিসের গন্ধ! কাঁচা পেঁয়াজ! দেখি।’

গঁদের শিশি কাছে টানিয়া লইয়া সে গভীরভাবে তাহার ঘ্রাণ লইল। শিশি কাত করিয়া দেখিল‌, ভিতরে গাঢ় শ্বেতাভ পদার্থ দেখিয়া গঁদের আঠা বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু তাহাতে পেঁয়াজের গন্ধ কেন? কোথা হইতে পেঁয়াজ আসিল?

গদের শিশি হাতে লইয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নিশ্চল বসিয়া রহিল। নিশ্চলতার অন্তরালে প্রচণ্ড মানসিক ক্রিয়া চলিতেছে তাহা তাহার চোখের তীব্র-প্রখর দৃষ্টি হইতে অনুমান করা হয়। আমি ইন্সপেক্টর হালদারের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। পেঁয়াজ-গন্ধী গঁদের শিশির মধ্যে ব্যোমকেশ কোন রহস্যের সন্ধান পাইল!

‘ইন্সপেক্টর হালদার‌, দয়া করে একবার কুশেশ্বরের স্ত্রীকে ডেকে আনবেন?’

অল্পক্ষণ পরে লাবণ্য প্রতি পদক্ষেপে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতে করিতে ঘরে প্রবেশ করিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া নিজের চেয়ার নির্দেশ করিয়া বলিল‌, ‘বসুন। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব।’

লাবণ্য উপবেশন করিল। তাহার চোয়ালের হাড় শক্ত‌, চক্ষে কঠিন সন্দিগ্ধতা। তিনজন অপরিচিত পুরুষ দেখিয়াও তাহার দৃষ্টি নরম হইল না।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার শ্বশুরমশায় কি কাঁচা পেঁয়াজ খেতে ভালোবাসতেন?’

লাবণ্য চকিতভাবে ব্যোমকেশের পানে চাহিল‌, তাহার মুখের বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হইল। সে বলিল‌, ‘ভালোবাসতেন না‌, কিন্তু যাবার কিছুদিন আগে কাঁচা পেঁয়াজের ওপর লোভ হয়েছিল। ভীমরতি অবস্থা হয়েছিল‌, তার ওপর একটিও দাঁত ছিল না; হামানদিস্তায় পেঁয়াজ ছেঁচে তাই খেতেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও। মৃত্যুর কতদিন আগে পেঁয়াজের বাতিক হয়েছিল?’

লাবণ্য ভাবিয়া বলিল‌, ‘দশ-বারো দিন আগে। চৈত্র মাসের শেষের দিকে।’

ব্যোমকেশ সহাস্যে হাত জোড় করিয়া বলিল‌, ‘ধন্যবাদ। আপনাদের মিছে কষ্ট দিলাম‌, সেজন্য ক্ষমা করবেন। চল অজিত‌, চলুন ইন্সপেক্টর হালদার। এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।’

কোথা দিয়া কেমন করিয়া কাজ শেষ হইল কিছুই বুঝিলাম না‌, আমরা গুটি গুটি বাহির হইয়া আসিলাম। ফুটপাথে নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ইন্সপেক্টর হালদার‌, আপনি চলুন আমাদের বাসায়। আপনার সঙ্গীদের আর দরকার হবে না।’

বাসায় পৌঁছিয়া সে আমাকে প্রশ্ন করিল‌, ‘অজিত‌, নববর্ষে রামেশ্বরবাবু আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন‌, সেটা কোথায়?’

এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলাম‌, ‘আমি তো সে-চিঠি আর দেখিনি। এইখানেই কোথাও আছে‌, যাবে কোথায়।’

আমাদের ব্যক্তিগত চিঠির কোনও ফাইল নাই‌, চিঠি পড়া হইয়া গেলে কিছু দিন যত্রতত্র পড়িয়া থাকে‌, তারপর পুঁটিরাম ঝাঁট দিয়া ফেলিয়া দেয়।

0 Shares