ব্যোমকেশ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া বলিল, ‘দ্যাখো-খুঁজে দ্যাখো, চিঠিখানা ভীষণ জরুরী। রামেশ্বরবাবু তাতে লিখেছিলেন–আমার এই চিঠিখানির প্রতি অবজ্ঞা দেখাইবেন না। তখন ও-কথায় মানে বুঝিনি–’
ইন্সপেক্টর হালদার বলিলেন, ‘কিন্তু কথাটা কি? ও-চিঠিখানা হঠাৎ এত জরুরী হয়ে উঠল কি করে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝতে পারলেন না! ওই চিঠিখানাই রামেশ্বরবাবুর উইল।’
‘অ্যাঁ। সেকি?’
‘হ্যাঁ। আজ গঁদের শিশিতে পেঁয়াজের রস দেখে বুঝতে পারলাম। রামেশ্বরবাবু অদৃশ্য কালি দিয়ে উইল লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।’
‘কিন্তু—অদৃশ্য কালি–’
‘পরে বলব। অজিত, চারিদিকে খুঁজে দ্যখো, পুঁটিরামকে ডাকে। ও-চিঠি যদি না পাওয়া যায়, নলিনী আর দেবনাথের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
পুঁটিরামকে ডাকা হইল, সে কিছু বলিতে পারিল না। ব্যোমকেশ মাথায় হাত দিয়া বসিল, তারপর পাংশু মুখ তুলিয়া বলিলল ‘থামো্্, থামো। বাইরে খুঁজলে হবে না, মনের মধ্যে খুঁজতে হবে।’
ইজি-চেয়ারে পা ছড়াইয়া শুইয়া সে সিগারেট ধরাইল, কড়িকাঠের পানে চোখ তুলিয়া ঘন ঘন ধূম উদগিরণ করিতে লাগিল।
আমরাও সিগারেট ধরাইলাম।
পনরো মিনিট পরে সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘সেদিন আমি কোন বই পড়ছিলাম মনে আছে?’
বলিলাম, ‘কবে? কোনদিন?’
‘যেদিন রামেশ্বরবাবুর চিঠিখানা এল। পয়লা বৈশাখ, বিকেলবেলা। মনে নেই?’
মনের পটে সেদিনের দৃশ্যটি আকিবার চেষ্টা করিলাম। পোস্টম্যান দ্বারে ঠকঠক শব্দ করিল; ব্যোমকেশ তক্তপোশে পদ্মাসনে বসিয়া একটা মোটা বই পড়িতেছিল; কালী সিংহের মহাভারত, না হেমচন্দ্র-কৃত রামায়ণ?
ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ‘মহাভারত, দ্বিতীয় খণ্ড। পিতামহ ভীষ্মের কথা উঠল মনে নেই?’
ছুটিয়া গিয়া শেলফ হইতে মহাভারতের দ্বিতীয় খণ্ড বাহির করিলাম। পাতা খুলিতেই খামসমেত রামেশ্বরবাবুর চিঠি বাহির হইয়া পড়িল।
ব্যোমকেশ উল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!-পুঁটিরাম, একটা আংটায় কয়লার আগুন তৈরি করে নিয়ে এস।’
৪
ব্যোমকেশের টেলিফোন পাইয়া ডাক্তার অসীম সেন আসিয়াছেন। নলিনী ও দেবনাথকে সঙ্গে লইয়া। ঘরের মেঝোয় আগুনের আংটা ঘরের বাতাবরণকে আরও উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছে।
ব্যোমকেশ চিঠিখানি সযত্নে হাতে ধরিয়া বলিতে আরম্ভ করিল–
‘রামেশ্বরবাবু হাস্যরসিক ছিলেন, উপরন্তু মহা বুদ্ধিমান ছিলেন। কিন্তু তাঁর শরীর অসমর্থ হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা তাঁর ছিলন। তিনি ছেলে আর পুত্রবধূর হাতের পুতুল হয়ে পড়েছিলেন।
‘তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে আসছে, তখন তাঁর ইচ্ছা হল মেয়েকেও কিছু ভাগ দিয়ে যাবেন। কিন্তু মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ দিতে গেলে উইল করতে হয়, বর্তমান আইন অনুসারে মেয়ের পিতৃ-সম্পত্তির ওপর কোনো স্বাভাবিক দাবি নেই। রামেশ্বরবাবু স্থির করলেন তিনি উইল করবেন।
‘কিন্তু শুধু উইল করলেই তো হয় না; তাঁর মৃত্যুর পর উইল যে বিদ্যমান থাকবে তার স্থিরতা কি? কুশেশ্বর আর লাবণ্য সম্পত্তির ভাগ নলিনীকে দেবে না, তারা নলিনীকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। তারা নলিনীকে বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না, সর্বদা রামেশ্বরবাবুকে আগলে থাকে; তিনি যে-সব চিঠি লেখেন তা খুলে তদারক করে, চিঠিতে সন্দেহজনক কোনো কথা থাকলে, চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
‘তবে উপায়? রমেশ্বরবাবু বুদ্ধি খেলিয়ে উপায় বার করলেন। সকলে জানে না, পেঁয়াজের রস দিয়ে চিঠি লিখলে কাগজের ওপর দাগ পড়ে না, লেখা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু ওই অদৃশ্য লেখা ফুটিয়ে তোলবার উপায় আছে, খুব সহজ উপায়। কাগজটা আগুনে তাতালেই অদৃশ্য লেখা ফুটে ওঠে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন ম্যাজিক দেখানোর শখ ছিল; অনেকবার সহপাঠীদের এই ম্যাজিক দেখিয়েছি।
‘রামেশ্বরবাবু এই ম্যাজিক জানতেন। তিনি আবদার ধরলেন, কাঁচা পেঁয়াজ খাবেন। তাঁর ছেলে-বৌ ভাবল ভীমরতির খেয়াল; তারা আপত্তি করল না। রামেশ্বরবাবু হামানদিস্তায় পান ছেচে খেতেন; তাঁর পান খাওয়ার শখ ছিল, কিন্তু দাঁত ছিল না। পেঁয়াজ হাতে পেয়ে তিনি হামানদিস্তায় থেতো করলেন; গঁদের শিশি থেকে গদ ফেলে দিয়ে তাতে পেঁয়াজের রস সঞ্চয় করে রাখলেন। কেউ জানতে পারল না। তাঁর প্রাণে হাস্যরস ছিল; এই কাজ করবার সময় তিনি নিশ্চয় মনে মনে খুব হেসেছিলেন।
‘পয়লা বৈশাখ তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখতেন। এবার নববর্ষ সমাগত দেখে তিনি চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। আমাকে প্রতি বছর চিঠি লেখেন, এবারও লিখলেন; তারপর চিঠির পিঠি অংশ পেঁয়াজের রস দিয়ে উইল লিখলেন। এই সেই চিঠি আর উইল।‘
ব্যোমকেশ খাম খুলিয়া সাবধানে চিঠি বাহির করিল, চিঠির ভাঁজ খুলিয়া দুই হাতে তাহার দুই প্রান্ত ধরিয়া আংটার আগুনের উপর ধীরে ধীরে সঞ্চালিত করিতে লাগিল। আমরা শ্বাস রুদ্ধ করিয়া সেইদিকে তাকাইয়া রহিলাম।
এক মিনিট রুদ্ধশ্বাসে থাকিবার পর আমাদের সমবেত নাসিকা হইতে সশব্দ নিশ্বাস বাহির হইল। কাগজের পিঠে বাদামী রঙের অক্ষর ফুটিয়া উঠিতেছে।
পাঁচ মিনিট পরে কাগজখানি আগুনের উপর হইতে সরাইয়া ব্যোমকেশ একবার তাহার উপর চোখ বুলাইল, তারপর তাহা ডাক্তার সেনের দিকে বাড়াইয়া বলিল, ‘ডাক্তার সেন, রামেশ্বরবাবু আপনাকে যে উইলের কথা বলেছিলেন, এই সেই উইল। —পড়ুন, আমরা সবাই শুনব।’