চিত্রচোর

ব্যোমকেশ গাত্ৰোত্থান করিয়া বলিল‌, ‘আপনি চিন্তা করবেন না‌, চোর কিছুই চুরি করতে পারেনি। গয়নার বাক্স নিরাপদে আছে‌, এমন কি‌, আপনার পরীও একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আজ তাহলে আমরা উঠি। মিস্টার পাণ্ডে‌, চোরের যদি সন্ধান পান আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’

পাণ্ডে হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন। আমরা বাহিরে আসিলাম; ঊষানাথবাবুও সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। ব্যোমকেশ ঊষানাথবাবুকে ইশারা করিয়া বারান্দার এক কোণে লইয়া গিয়া চুপিচুপি কিছুক্ষণ কথা বলিল। তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, ‘চল।’

রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করিতেছিল‌, আমরা ফিরিয়া চলিলাম। ব্যোমকেশ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল‌, তারপর এক সময় বলিল‌, ‘অজিত‌, ঊষানাথবাবু এক সময় চোখের চশমা তুলেছিলেন‌, তখন কিছু লক্ষ্য করেছিলে?’

‘কৈ না। কি লক্ষ করব?’

‘ঊষানাথবাবুর বাঁ চোখটা পাথরের।’

‘তাই নাকি? কালো চশমার এই অর্থ?’

‘হাঁ। বছর তিনেক আগে ওঁর চোখের ভেতরে ফোড়া হয়‌, অস্ত্ৰ করে চোখটা বাদ দিতে হয়েছিল। ওঁর সর্বদা ভয় সাহেবরা জানতে পারলেই ওঁর চাকরি যাবে।’

‘আচ্ছা ভীতু লোক তো! এই কথাই বুঝি আড়ালে গিয়ে হচ্ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

এই তথ্যের গুরুত্ব কতখানি তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না। ঊষানাথবাবু যদি কানাই হন তাহাতে পৃথিবীর কি ক্ষতিবৃদ্ধি?

রিকশা ক্ৰমে বাড়ির নিকটবর্তী হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অজিত‌, যাবার সময় তুমি প্রশ্ন করেছিলে‌, ছবি চুরির ব্যাপার গুরুতর কি না। সে প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া যেতে পারে। ব্যাপার গুরুতর।’

‘সত্যি? কি করে বুঝলে?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না‌, একটু মুচকি হাসিল।

অপরাহ্নে আমরা মহীধরবাবুর বাড়িতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। সত্যবতী বলিল‌, ‘ঠাকুরপো‌, টর্চ নিয়ে যেও। ফিরতে রাত করবে নিশ্চয়।’

আমি টর্চ পকেটে লইয়া বলিলাম‌, ‘তুমি এবেলাও তাহলে বেরুচ্ছ না?’

সত্যবতী বলিল‌, ‘না। ওপরতলায় একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে‌, কথা কইবার লোক নেই। তার কাছে দুদণ্ড বসে দুটো কথা কইলেও তার মনটা ভাল থাকবে।’

বলিলাম‌, ‘মালতী দেবীর প্রতি তোমার সহানুভুতি যে ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে।’

‘কেন বাড়বে না? নিশ্চয় বাড়বে।’

আর রজনীর প্রতি সহানুভূতি বোধ করি সেই অনুপাতে কমে যাচ্ছে?’

‘মোটেই না‌, একটুও কমেনি। রজনীর দোষ কি? যত নষ্ট্রের গোড়া এই পুরুষ জাতটা।’

তর্জন করিয়া বলিলাম‌, ‘দেখ‌, জাত তুলে কথা বললে ভাল হবে না বলছি।’

সত্যবতী নাক সিটকাইয়া রান্নাঘরের দিকে প্ৰস্থান করিল।

মহীধর বাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছিলাম তখন সূৰ্য্যস্ত হয় নাই বটে‌, কিন্তু বাগানের মধ্যে ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে। খোলা ফটকে লোক নাই। রাত্রেও বোধ হয়। ফটক খোলা থাকে‌, কিংবা গরু ছাগলের গতিরোধ করিবার জন্য আগড় লাগানো থাকে। মানুষের যাতায়াতে বাধা নাই।

বাড়ির সদর দরজা খোলা; কিন্তু বাড়িতে কেহ আছে বলিয়া মনে হইল না। দুই-তিন বার হেষা-ধ্বনিবৎ গলা খাঁকারি দিবার পর একটি বৃদ্ধগোছের চাকর বাহির হইয়া আসিল। বলিল‌, ‘কতাবাবু ওপরে শুয়ে আছেন। দিদিমণি বাগানে বেড়াচ্ছেন। আপনারা বসুন‌, আমি ডেকে আনছি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দরকার নেই–আমরাই দেখছি।’ বাগানে নামিয়া ব্যোমকেশ বাগানের একটা কোণ লক্ষ্য করিয়া চলিল। গাছপালা ঝোপঝাড়ে বেশিদূর পর্যন্ত দেখা যায় না‌, কিন্তু ঘাসে ঢাকা সঙ্কীর্ণ পথগুলি মাকড়সার জালের মত চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া গিয়াছে। বুঝিলাম ব্যোমকেশ ফাল্গুনী পালের আস্তানার সন্ধানে চলিয়াছে।

বাগানের কোণে আসিয়া পৌঁছিলাম। একটা মাটির ঘর‌, মাথায় টালির ছাউনি; সম্ভবত মালীদের যন্ত্রপাতি রাখিবার স্থান। পাশেই একটা প্ৰকাণ্ড ইঁদারা।

ঘরের দ্বার খোলা রহিয়াছে‌, কিন্তু ভিতরে অন্ধকার। আমি টর্চের আলো ভিতরে ফেলিলাম। অন্ধকারে খড়ের বিছানার উপর কেহ শুইয়াছিল‌, আলো পড়িতেই উঠিয়া বাহিরে আসিল। দেখিলাম ফাল্গুনী পাল।

আজ ফাল্গুনীর মন ভাল নয়‌, কণ্ঠস্বরে ঔদাসীন্য-ভরা অভিমান। আমাদের দেখিয়া বলিল‌, ‘আপনারাও কি পুলিসের লোক‌, আমার ঘর খানাতল্লাস করতে এসেছেন? আসুন-দেখুন‌, প্রাণ ভরে খানাতল্লাস করুন। কিছু পাবেন না। আমি গরীব বটে‌, কিন্তু চোর নই।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা খানাতল্লাস করতে আসিনি। আপনাকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। কাল রাত্রে আপনি ঊষানাথবাবুর বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন?’

ফাল্গুনী তিক্তস্বরে বলিল‌, ‘তাঁর একটা ছবি এঁকেছিলাম‌, তাই দেখাতে গিয়েছিলাম। দারোয়ান দেখা করতে দিলে না‌, তাড়িয়ে দিলে। বেশ কথা‌, ভাল কথা। কিন্তু সেজন্য পুলিস লেলিয়ে দেবার কি দরকার?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভারি অন্যায়। আমি পুলিসকে বলে দেব‌, তারা আপনাকে আর বিরক্ত করবে না।’

‘ধন্যবাদ’ বলিয়া ফন্ধুনী আবার কোটরে প্রবেশ করিল। আমরা ফিরিয়া আসিলাম। দিনের আলো প্ৰায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। আমরা বাগানে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম‌, কিন্তু রজনীকে দেখিতে পাইলাম না।

বাগানের অন্য প্রান্তে বড় বড় পাথরের চ্যাঙড় দিয়া একটা উচ্চ ক্রীড়াশৈল রচিত হইয়াছিল। তাহাকে ঘিরিয়া সবুজ শ্যাওলার বন্ধনী। ক্রীড়াশৈলটি আকারে চারকোণা‌, দেখিতে অনেকটা পিরামিডের মত। আমরা তাহার পাশ দিয়া যাইতে যাইতে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। পিরামিডের অপর পার হইতে আবেগোন্ধত কণ্ঠস্বর কানে আসিল‌, ‘ছবি ছবি ছবি। কি হবে ছবি! চাই না ছবি।’

‘আস্তে! কেউ শুনতে পাবে।’

0 Shares