চিত্রচোর

কণ্ঠস্বর দুইটি পরিচিত; প্রথমটি ডাক্তার ঘটকের‌, দ্বিতীয়টি রজনীর। ডাক্তার ঘটককে আমরা শান্ত সংযতবাক মানুষ বলিয়াই জানি; তাহার কণ্ঠ হইতে যে এমন আর্ত উগ্রতা বাহির হইতে পারে তাহা কল্পনা করাও দুষ্কর। রজনীর কণ্ঠস্বরেও একটা শীৎকার আছে‌, কিন্তু তাহা অস্বাভাবিক নয়।

ডাক্তার ঘটক আবার যখন কথা কহিল তখন তাহার স্বর অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব হইয়াছে বটে‌, কিন্তু আবেগের উন্মাদনা কিছুমাত্র কমে নাই। সে বলিল‌, ‘আমি তোমাকে চাই-তোমাকে। দুধের বদলে জল খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না।’

রজনী বলিল‌, ‘আর আমি! আমি কি চাই না? কিন্তু উপায় যে নেই।’

ডাক্তার বলিল‌, ‘উপায় আছে‌, তোমাকে বলছি।’

রজনী বলিল‌, ‘কিন্তু বাবা—’

ডাক্তার বলিল‌, ‘তুমি নাবালিকা নাও। তোমার বাবা তোমাকে আটকাতে পারেন না।’

রজনী বলিল‌, ‘তা জানি। কিন্তু।–শোন লক্ষ্মীটি শোন‌, বাবার শরীর খারাপ যাচ্ছে‌, তিনি সেরে উঠুন।–তারপর—’

ডাক্তার বলিল‌, ‘না। আজই আমি জানতে চাই তুমি রাজী আছ কি না।’

একটু নীরবতা। তারপর রজনী বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, আজই বলব‌, কিন্তু এখন নয়। আমাকে একটু সময় দাও। আজ রাত্রি সাড়ে দশটার সময় তুমি এস‌, আমি এখানে থাকবো; তখন কথা হবে। এখন হয়তো বাড়িতে কেউ এসেছে‌, আমাকে না দেখলে–’

ব্যোমকেশ নিঃশব্দে আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল।

দু’জনে পা টিপিয়া ফিরিয়া আসিতেছি‌, হঠাৎ চোখে পড়িল পিরামিডের অন্য পাশ হইতে আর একটা লোক আমাদেরই মত সন্তৰ্পণে দূরে চলিয়া যাইতেছে। একবার মনে হইল বুঝি ডাক্তার ঘটক; কিন্তু ভাল করিয়া চিনিবার আগেই লোকটি অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

পিরামিড হইতে অনেকখানি ঘুরিয়া দূরে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, বাড়ি ফেরা যাক। আজ আর দেখা করে কোজ নেই।’

রাস্তায় বাহির হইলাম। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে‌, আকাশে চন্দ্ৰ নাই‌, পথের পাশে কেরোসিনের আলোগুলি দূরে দূরে মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। আমি মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালিয়া পথ নির্ণয় করিতে করিতে চলিলাম।

ব্যোমকেশ চিন্তায় মগ্ন হইয়া আছে। বিদ্রোহোম্মুখ যুবক-যুবতীর নিয়তি কোন কুটিল পথে চলিয়াছো-বোধ করি তাঁহাই নিধারণের চেষ্টা করিতেছে। আমি তাহার ধ্যানভঙ্গ করিলাম না।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করিল‌, ‘অন্য লোকটিকে চিনতে পারলে?’

বলিলাম‌, না। কে তিনি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনি হচ্ছেন আমাদের গৃহস্বামী অধ্যাপক আদিনাথ সোম।’

‘তাই নাকি! ব্যোমকেশ‌, ব্যাপারটা আমার পক্ষে কিছু জটিল হয়ে উঠেছে। ছবি চুরি‌, পরী চুরি‌, নেশাখোর চিত্রকর‌, কানা হাকিম‌, অবৈধ প্রণয়‌, অধ্যাপকের আড়িপাতা—কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘না পারবারই কথা। রবীন্দ্রনাথের গান মনে আছে—‘জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে‌, জীবন-বীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে?’—আমিও সরু-মোটা তারের জট ছাড়াতে পারছি না।’

‘আচ্ছা‌, এই যে ডাক্তার আর রজনীর ব্যাপার‌, এতে আমাদের কিছু করা উচিত নয় কি?’

ব্যোমকেশ দৃঢ়স্বরে বলিল‌, ‘কিছু নয়। আমরা ক্রিকেট খেলার দর্শক‌, হাততালি দিতে পারি‌, দুয়ো দিতে পারি‌, কিন্তু খেলার মাঠে নেমে খেলায় বাগড়া দেওয়া আমাদের পক্ষে ঘোর বেয়াদপি।’

বাড়ি ফিরিয়া দেখিলাম সত্যবতী একাকিনী পশমের গেঞ্জি বুনিতেছে। বলিলাম‌, ‘তোমার রুগীর খবর কি?’

সত্যবতী উত্তর দিল না‌, সেলাইয়ের উপর ঝুঁকিয়া দ্রুত কাঁটা চালাইতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কি‌, মুখে কথা নেই যে! মালতী দেবীকে দেখতে গিয়েছিলে তো?’

‘গিয়েছিলাম’—সত্যবতী মুখ তুলি না‌, কিন্তু তাহার মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠতে লাগিল।

ব্যোমকেশ অদূরে দাঁড়াইয়া লক্ষ্য করিতেছিল‌, হঠাৎ হো হো করিয়া হাসিয়া নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। সত্যবতী সূচীবিদ্ধবৎ চমকিয়া উঠিল‌, শয়নকক্ষের দ্বারের দিকে একটা ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করিল‌, তারপর আবার সম্মুখে ঝুকিয়া দ্রুত কাঁটা চালাইতে লাগিল।

আমি তাহার পাশে বসিয়া বলিলাম‌, ‘কি ব্যাপার খুলে বল দেখি।’

‘কিছু না। চা খাবে তো? জল চড়াতে বলে এসেছি। দেখি–বলিয়া সে উঠিবার উপক্রম করিল।

আমি বাধা দিয়া বলিলাম‌, আহা‌, কি হয়েছে আগে বল না! চা পরে হবে।’

আমার যাওয়াই ভুল হয়েছিল। এমন পচা নোংরা মন–আমাকে বলে কিনা–কিন্তু সে আমি বলতে পারব না। যার অমন মন তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয়।’

শয়নকক্ষ হইতে আর এক ধমক হাসির আওয়াজ আসিল। সত্যবতী চলিয়া গেল। ব্যাপার বুঝিতে বাকি রহিল না। রাগে আমার মুখও উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সন্দিগ্ধমনা স্ত্রীলোকের সন্দেহ পাত্ৰপাত্রী বিচার করে না জানি‌, কিন্তু সত্যবতীকে যে স্ত্রীলোক এরূপ পঙ্কিল দোষারোপ করিতে পারে‌, তাকে গুলি করিয়া মারা উচিত। ব্যোমকেশ হাসুক‌, আমার গা রি রি করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

রাত্ৰে শয়ন করিতে গিয়া ঘুম আসিল না; সারাদিনের নানা ঘটনায় মাথা গরম হইয়া উঠিয়াছে। ঘড়িতে দেখিলাম দশটা; ডিসেম্বর মাসে রাত্রি দশটা এখানে গভীর রাত্রি। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী অনেকক্ষণ শুইয়া পড়িয়াছে।

বিছানায় শুইয়া ঘুম না আসিলে আমার সিগারেটের পিপাসা জাগিয়া ওঠে‌, সুতরাং শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিতে হইল। গায়ে আলোয়ান দিয়া সিগারেট ধরাইলাম। কিন্তু বদ্ধ ঘরে ধূমপান করিলে ঘরের বাতাস ধোঁয়ায় দূষিত হইয়া উঠিবে; আমি একটা জানলা ঈষৎ খুলিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইয়া সিগারেট টানিতে লাগিলাম।

জানালাটা সদরের দিকে। সামনে ফটক‌, তাহার পরপারে রাস্তা‌, রাস্তার ধারে মিউনিসিপ্যালিটির আলোকস্তম্ভ; আলোকস্তম্ভ না বলিয়া ধূমস্তম্ভ বলিলেই ভাল হয়। প্ৰদীপের তৈল শেষ হইয়া আসিতেছে।

0 Shares