চিত্রচোর

মিনিট দুই তিন জানালার কাছে দাঁড়াইয়া আছি‌, বাহিরে একটা অস্পষ্ট খস খাস শব্দে চকিত হইয়া উঠিলাম। কে যেন বারান্দা হইতে নামিতেছে। জানালার ফাঁক দিয়া দেখিলাম একটি ছায়ামূর্তি ফটক পার হইয়া বাহিরে চলিয়া গেল। আলোকস্তম্ভের পাশ দিয়া যাইবার সময় তাহাকে চিনিতে পারিলাম-কালো কোট-প্যান্ট-পরা অধ্যাপক সোম।

বিদ্যুৎ চমকের মত বুঝিতে পারিলাম। এত রাত্রে তিনি কোথায় যাইতেছেন। আজ রাত্রি সাড়ে দশটার সময় মহীধরবাবুর বাগানে ডাক্তার ঘটক এবং রজনীর মিলিত হইবার কথা; সঙ্কেত-স্থলে সোম অনাহুত উপস্থিত থাকিবেন। কিন্তু কেন? কি তাঁহার অভিপ্ৰায়?

বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া মনে মনে এই কথা ভাবিতেছি‌, সহসা অধিক বিস্ময়ের কারণ ঘটিল। আবার খসি খসি শব্দ শুনিতে পাইলাম। এবার বাহির হইয়া আসিল মালতী দেবী। তাঁহাকে চিনিতে কষ্ট হইল না। একটা চাপা কাশির শব্দ; তারপর সোম যে পথে গিয়াছিলেন তিনিও সেই পথে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

পরিস্থিতি স্পষ্টই বোঝা গেল। স্বামী অভিসারে যাইতেছেন‌, আর স্ত্রী অসুস্থ শরীর লইয়া এই শীতজর্জর রাত্রে তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছেন। বোধ হয় স্বামীকে হাতে হাতে ধরিতে চান। উঃ‌, কি দুৰ্বহ ইহাদের জীবন! প্রেমহীন স্বামী এবং বিশ্বাসহীন পত্নীর দাম্পত্য জীবন কি ভয়ঙ্কর। এর চেয়ে ডাইভোর্স ভাল।

বর্তমান ক্ষেত্রে আমার কিছু করা উচিত কিনা ভাবিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশকে জাগাইয়া সংবাদটা দিব? না‌, কাজ নাই‌, সে ঘুমাইতেছে ঘুমাক। বরং আমার ঘুম যেরূপ চটিয়া গিয়াছে‌, দুঘণ্টার মধ্যে আসিবে বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং আমি জানালার কাছে বসিয়া পাহারা দিব। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

আবার সিগারেট ধরাইলাম।

পাঁচ মিনিট‌, দশ মিনিট। দীপস্তম্ভের আলো ধোঁয়ায় দম বন্ধ হইয়া মরিয়া গেল।

একটি মূর্তি ফটক দিয়া প্রবেশ করিল। নক্ষত্রের আলোয় মালতী দেবীর ভারী মোটা চেহারা চিনিতে পারিলাম। তিনি পদশব্দ গোপনের চেষ্টা করিলেন না। তাঁহার কণ্ঠ হইতে একটা অবরুদ্ধ আওয়াজ বাহির হইল‌, তাহা চাপা কাশি কিংবা চাপা কান্না বুঝিতে পারিলাম না। তিনি উপরে চলিয়া গেলেন।

এত শীঘ্ৰ শ্ৰীমতী ফিরিয়া আসিলেন‌, কিন্তু শ্ৰীমানের দেখা নাই। অনুমান করিলাম শ্ৰীমতী বেশি দূর স্বামীকে অনুসরণ করিতে পারেন নাই‌, অন্ধকারে হারাইয়া ফেলিয়াছেন। তারপর এদিক ওদিক নিষ্ফল অন্বেষণ করিয়া গৃহে ফিরিয়াছেন।

সোম ফিরিলেন সাড়ে এগারটার সময়। বাদুড়ের মত নিঃশব্দ সঞ্চারে বাড়ির মধ্যে মিলাইয়া গেলেন।

সকালে ব্যোমকেশকে রাত্রির ঘটনা বলিলাম। সে চুপ করিয়া শুনিল‌, কোনও মন্তব্য করিল না।

একজন কনস্টেবল একটা চিঠি দিয়া গেল। ডি.এস.পি‌, পাণ্ডের চিঠি‌, আগের দিন সন্ধ্যা ছ’টার তারিখ। চিঠিতে মাত্র কয়েক ছত্র লেখা ছিল–

প্রিয় ব্যোমকেশবাবু্‌,

ডেপুটি সাহেবের আলমারি খুলিয়া দেখা গেল কিছু চুরি যায় নাই। আপনি বলিয়াছিলেন পরীকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে‌, কিন্তু পরী এখনও নিরুদ্দেশ। চোরেরও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আপনি জানিতে চাহিয়াছিলেন। তাই লিখিলাম। ইতি—

পুরন্দর পাণ্ডে

ব্যোমকেশ চিঠিখানা পকেটে রাখিয়া বলিল‌, ‘পাণ্ডে লোকটি সত্যিকার সজ্জন।’

এই সময় যিনি সবেগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন তিনি ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার। মহীধর বাবুর পাটির পর রাস্তায় নকুলেশবাবুর সহিত দু’একবার দেখা হইয়াছিল। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলিলেন‌, ‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম‌, ভাবলাম খবরটা দিয়ে যাই। শোনেননি। নিশ্চয়ই? ফাল্গুনী পাল-সেই যে ছবি আঁকত—সে মহীধরবাবুর বাগানে কুয়োয় ডুবে মরেছে।’

কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কখন এ ব্যাপার হল?’

নকুলেশ বলিলেন‌, ‘বোধ হয় কাল রাত্তিরে‌, ঠিক জানি না। মাতাল দাঁতাল লোক‌, অন্ধকারে তাল সামলাতে পারেনি‌, পড়েছে কুয়োয়। আজ সকালে আমি মহীধরবাবুর খবর নিতে গিয়েছিলাম‌, দেখি মালীরা কুয়ো থেকে লাস তুলছে।’

আমরা নীরবে পরস্পর পরস্পরের মুখের পানে চাহিলাম। কাল রাত্রে মহীধরবাবুর বাগানে বহু বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়াছে।

‘আচ্ছা‌, আজ তাহলে উঠি; আমাকে আবার ক্যামেরা নিয়ে ফিরে যেতে হবে–।’ বলিয়া নকুলেশবাবু উঠিবার উপক্ৰম করিলেন।

‘বসুন বসুন‌, চা খেয়ে যান।’

নকুলেশ চায়ের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারিলেন না‌, বসিলেন। অচিরাৎ চা আসিয়া পড়িল। দুচার কথার পর ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সেই গ্রুপ-ফটোর নেগেটিভখানা খুঁজেছিলেন কি?’

‘কোন নেগেটিভ? ও-হ্যাঁ‌, অনেক খুঁজেছি মশাই‌, পাওয়া গেল না। —আমার লোকসানের বরাত; থাকলে আরও পাঁচখানা বিক্রি হত।’

‘আচ্ছা‌, সেই ফটোতে কে কে ছিল বলুন দেখি?’

‘কে কে ছিল? পিকনিকে গিয়েছিলাম ধরুন–আমি‌, মহীধরবাবু্‌, তাঁর মেয়ে রজনী‌, ডাক্তার ঘটক‌, সস্ত্রীক প্রোফেসর সোম‌, সপরিবারে ডেপুটি ঊষানাথবাবু আর ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা। সকলেই ফটোতে ছিলেন। ফটোখানা ভারি উৎরে গিয়েছিল–গ্রুপ-ফটো অত ভাল খুব একটা হয় না। আচ্ছা‌, চলি তাহলে। আর একদিন আসিব।’

নকুলেশবাবু প্ৰস্থান করিলেন। দু’জনে কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। ফাল্গুনীর কথা ভাবিয়া মনটা ভারী হইয়া উঠিল। সে নেশাখোর লক্ষ্মীছাড়া ছিল‌, কিন্তু ভগবান তাহাকে প্রতিভা দিয়াছিলেন। এমনভাবে অপঘাত মৃত্যুই যদি তাহার নিয়তি‌, তবে তাহাকে প্রতিভা দিবার কি প্রয়োজন ছিল?

0 Shares