ব্যোমকেশ একটি জানালার বাহিরে দাঁড়াইয়া চেক লিখিতেছে, দেখিলাম বেড়ার ভিতর দিকে ম্যানেজার অমরেশ রাহা দাঁড়াইয়া একজন কেরানীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। অমরেশবাবুও আমাদের দেখিতে পাইয়াছিলেন, তিনি স্মিতমুখে বাহিরে আসিলেন। বলিলেন, নমস্কার। ভাগ্যে আপনাদের দেখে ফেললাম নইলে তো টাকা নিয়েই চলে যেতেন।’
অমরেশবাবুকে চায়ের পার্টির পর আর দেখি নাই। তিনি সেজন্য লজ্জিত; ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, ‘রোজই মনে করি আপনাদের বাড়িতে যাব, কিন্তু একটা না একটা কাজ পড়ে যায়। ব্যাঙ্কের চাকরি মানে অষ্টপ্রহরের গোলামি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এমন গোলামিতে সুখ আছে। হরদম টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।’
অমরেশবাবু করুণ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘সুখ আর কৈ ব্যোমকেশবাবু। চিনির বলদ চিনির বোঝা বয়ে মরে, কিন্তু দিনের শেষে খায় সেই ঘাস জল।’
ব্যোমকেশ চেকের বদলে টাকা পকেটস্থ করিলে অমরেশবাবু বলিলেন, ‘চলুন, আজ যখন পেয়েছি আপনাকে সহজে ছাড়ব না। আমার আপিস-ঘরে বসে খানিক গল্প-সল্প করা যাক। আপনার প্রতিভার যে পরিচয় অজিতবাবুর লেখা থেকে পাওয়া যায়, তাতে আপনাকে পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আমাদের দেশে প্রতিভাবান মানুষের বড়ই অভাব।’
ভদ্রলোক শুধু যে ব্যোমকেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁহাই নয়, সাহিত্য-রসিকও বটে। সেদিন তাঁহার সহিত অধিক আলাপ করি নাই বলিয়া অনুতপ্ত হইলাম।
তিনি আমাদের ভিতরে লইয়া গেলেন। তাঁহার একটি নিজস্ব আপিস-ঘর আছে, তাহার দ্বার পর্যন্ত গিয়া তিনি বলিলেন, ‘না, এখানে নয়। চলুন, ওপরে যাই। এখানে গণ্ডগোল, কাজের হুড়োহুড়ি। ওপরে বেশ নিরিবিলি হবে।’
আপিস-ঘরের দরজা খোলা ছিল; ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, মামুলি টেবিল চেয়ার খাতপত্র, কয়েকটা বড় বড় লোহার সিন্দুক ছাড়া আর কিছু নাই।
কাছেই সিঁড়ি। উপরে উঠিতে উঠিতে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওপরতলাটা বুঝি আপনার কোয়ার্টার?’
‘হ্যাঁ। ব্যাঙ্কেরও সুবিধে।’
‘স্ত্রী-পুত্র পরিবার সব এখানেই থাকেন?’
‘স্ত্রী-পুত্র পরিবার আমার নেই ব্যোমকেশবাবু। ভগবান সুমতি দিয়েছিলেন, বিয়ে করিনি। একলা-মানুষ, তাই ভদ্রভাবে চলে যায়। বিয়ে করলে হাড়ির হাল হত।’
উপরন্তলাটি একজন লোকের পক্ষে বেশ সুপরিসর। তিন চারটি ঘর, সামনে উন্মুক্ত ছাদ। অমরেশবাবু আমাদের বসিবার ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। অনাড়ম্বর পরিচ্ছন্ন ঘর; দেওয়ালে ছবি নাই, মেঝেয় গালিচা নাই। এক পাশে একটি জাজিম-ঢাকা চৌকি, দুই-তিনটি আরাম-কেদারা, একটি বইয়ের আলমারি। নিতান্তাই মামুলি ব্যাপার, কিন্তু বেশ তৃপ্তিদায়ক। গৃহস্বামী যে গোছালো স্বভাবের লোক তাহা বোঝা যায়।
‘বসুন, চা তৈরি করতে বলি।’ বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।
বইয়ের আলমারিটা আমাকে আকর্ষণ করিতেছিল, উঠিয়া গিয়া বইগুলি দেখিলাম। অধিকাংশ বই গল্প উপন্যাস, চলস্তিকা আছে, সঞ্চয়িতা আছে। আমার রচিত ব্যোমকেশের উপন্যাসগুলিও আছে দেখিয়া পুলকিত হইলাম।
ব্যোমকেশও আসিয়া জুটিল। সে একখানা বই টানিয়া লইয়া পাতা খুলিল; দেখিলাম বইখানা বাংলা ভাষায় নয়, ভারতবর্ষেরই অন্য কোনও প্রদেশের লিপি। অনেকটা হিন্দীর মতন, কিন্তু ঠিক হিন্দী নয়।
এই সময় অমরেশবাবু ফিরিয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি গুজরাটী ভাষাও জানেন?’
অমরেশবাবু মুখে চট্কার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘জানি আর কৈ? একসময় শেখবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ও আমার দ্বারা হল না। বাঙালীর ছেলে মাতৃভাষা শিখতেই গলদঘর্ম হয়, তার ওপর ইংরিজি আছে। উপরন্তু যদি একটা তৃতীয় ভাষা শিখতে হয় তাহলে আর বাঙালীর শক্তিতে কুলোয় না। অথচ শিখতে পারলে আমার উপকার হত। ব্যাঙ্কের কাজে গুজরাটী ভাষা জানা থাকলে অনেক সুবিধা হয়।’
আমরা আবার আসিয়া বসিলাম। দুই-চারিটি একথা সেকথার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘ফাল্গুনী পাল মারা গেছে শুনেছেন বোধ হয়?’
অমরেশবাবু চেয়ার হইরে প্রায় লাফাইয়া উঠিলেন, ‘অ্যাঁ। ফাল্গুনী পাল মারা গেছে! কবে—কোথায়–কি করে মারা গেল?’
ব্যোমকেশ ফাল্গুনীর মৃত্যু-বিবরণ বলিল। শুনিয়া অমরেশবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘আহা বেচারা! বড় দুঃখে পড়েছিল। কাল আমার কাছে এসেছিল।’
এবার আমাদের বিস্মিত হইবার পালা। ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ‘কাল এসেছিল? কখন?’
অমরেশবাবু বলিলেন, ‘সকালবেলা। কাল রবিবার ছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ; সবে চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে বসেছি, ফাল্গুনী এসে হাজির, আমার ছবি এঁকেছে তাই দেখাতে এসেছিল–’
‘ও—’
চাকর তিন পেয়ালা চা দিয়া গেল। তকমা-আঁটা চাকর, বুঝিলাম ব্যাঙ্কের পিওন; অবসরকালে বাড়ির কাজও করে। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল অমরেশবাবু টাকা-পয়সার ব্যাপারে বিলক্ষণ হিসাবী।
ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চামচ ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, ছবিখানা কিনলেন নাকি?’
অমরেশবাবু বিমর্ষ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘কিনতে হল। পাঁচ টাকা দিতে গেলাম কিছুতেই নিলে না, দশ টাকা আদায় করে ছাড়ল। এমন জানলে–’
ব্যোমকেশ চায়ে একটা চুমুক দিয়া বলিল, ‘মৃত চিত্রকরের শেষ ছবি দেখবার ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘দেখুন না। ভালই এঁকেছে বোধ হয়। আমি অবশ্য ছবির কিছু বুঝি না—’
বইয়ের আলমারির নীচের দেরাজ হইতে একখণ্ড পুরু চতুষ্কোণ কাগজ আনিয়া তিনি আমাদের সম্মুখে ধরিলেন।
ফাল্গুনী ভাল ছবি আঁকিয়াছে; অমরেশবাবুর বিশেষত্বহীন চেহারা উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। ব্যোমকেশ চিত্রবিদ্যার একজন জহুরী, সে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া ছবিটি দেখিতে লাগিল।