চিত্রচোর

অমরেশবাবু আগে বেশ প্রফুল্লমুখে কথাবার্তা বলিতেছিলেন‌, কিন্তু ফাল্গুনীর মৃত্যু-সংবাদ শুনিবার পর কেমন যেন মুষড়াইয়া পড়িয়াছেন। প্রায় নীরবেই চা-পান শেষ হইল। পেয়ালা রাখিয়া অমরেশবাবু স্তিমিত স্বরে বলিলেন‌, ফাল্গুনীর কথায় মনে পড়ল‌, সেদিন চায়ের পার্টিতে শুনেছিলাম পিকনিকের ফটোখানা চুরি গেছে। মনে আছে? তার কোনও হদিস পাওয়া গেল কিনা কে জানে।’

ব্যোমকেশ মগ্ন হইয়া ছবি দেখিতেছিল‌, উত্তর দিল না। আমিও কিছু বলা উচিত। কিনা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মত অমরেশবাবুর পানে চাহিয়া রহিলাম। অমরেশবাবু তখন নিজেই বলিলেন‌, ‘সামান্য ব্যাপার‌, তাই ও নিয়ে বোধ হয়। কেউ মাথা ঘামায়নি।’

ব্যোমকেশ ছবি নামাইয়া রাখিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল‌, ‘চমৎকার ছবি। লোকটা যদি বেঁচে থাকত‌, আমিও ওকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিতাম। অমরেশবাবু্‌, ছবিখানা যত্ন করে রাখবেন। আজ ফাল্গুনী পালের নাম কেউ জানে না‌, কিন্তু একদিন আসবে যেদিন ওর আঁকা ছবি সোনার দরে বিক্রি হবে।’

অমরেশবাবু একটু প্ৰফুল্ল হইয়া বলিলেন‌, ‘তাই নাকি! তাহলে দশটা টাকা জলে পড়েনি? ছবিটা বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙানো চলবে?

‘নিশ্চয়।’

অতঃপর আমরা গাত্ৰোত্থান করিলাম। অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘আবার দেখা হবে। বছর শেষ হতে চলল‌, আমাকে আবার নববর্ষের ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে হেড আপিসের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। এবার নববর্ষে দুদিন ছুটি।’

‘দুদিন ছুটি কেন? ‘এবার একত্ৰিশে ডিসেম্বর রবিবার পড়েছে। শনিবার যদি অর্ধেক দিন ধরেন‌, তাহলে আড়াই দিন ছুটি পাওয়া যাবে। আপনারা এখনও কিছুদিন আছেন তো?

‘২রা জানুয়ারি পর্যন্ত আছি বোধ হয়।’

আচ্ছা‌, নমস্কার।’

আমরা বাহির হইলাম। ব্যাঙ্কের ভিতর দিয়া নামিতে হইল না‌, বাড়ির পিছন দিকে একটা খিড়কি-সিঁড়ি ছিল‌, সেই পথে নামিয়া রাস্তায় আসিলাম। বাজারের মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল সিগারেট ফুরাইয়াছে। বলিলাম‌, ‘এস‌, এক টিন সিগারেট কিনতে হবে।’

ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক ছিল‌, চমকিয়া উঠিল। বলিল‌, ‘আরে তাই তো! আমাকেও একটা জিনিস কিনতে হবে।’

একটা বড় মনিহারীর দোকানে ঢুকিলাম। আমি একদিকে সিগারেট কিনিতে গেলাম‌, ব্যোমকেশ অন্যদিকে গেল। আমি সিগারেট কিনিতে কিনিতে আড়চোখে দেখিলাম ব্যোমকেশ একটা দামী এসেন্সের শিশি কিনিয়া পকেটে পুরিল।

মনে মনে হাসিলাম। ইহারা কেন যে ঝগড়া করে‌, কেনই বা ভাব করে কিছু বুঝি না। দাম্পত্য-জীবন আমার কাছে একটা হাস্যকর প্রহেলিকা।

সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিবার জন্য বিছানায় লম্বা হইয়াছিলাম‌, ঘুম ভাঙিয়া দেখি বেলা সাড়ে তিনটা।

ব্যোমকেশের ঘর হইতে মৃদু জল্পনার শব্দ আসিতেছিল; উঁকি মারিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ চেয়ারে বসিয়াছে এবং সত্যবতী তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া দুই হাতে তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে কি সব বলিতেছে। দু’জনের মুখেই হাসি।

সরিয়া আসিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলাম‌, ‘ওহে কপোত-কপোতী‌, তোমাদের কুজন-গুঞ্জন শেষ হতে যদি দেরি থাকে তাহলে না হয় আমিই চায়ের ব্যবস্থা করি।’।

সত্যবতী। সলজভাবে মুখের খানিকটা আচলের আড়াল দিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল। খানিক পরে ব্যোমকেশ জ্বলন্ত সিগারেট হইতে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বাহির হইল। অবাক হইয়া বলিলাম‌, ব্যাপার কি! ইঞ্জিনের মত ধোঁয়া ছাড়ছ যে।’

ব্যোমকেশ একগাল হাসিয়া বলিল‌, ‘পারমিশন পেয়ে গেছি। আজ থেকে যত ইচ্ছে।’

বুঝিলাম দাম্পত্য-জীবনে কেবল প্ৰেম থাকিলেই চলে না‌, কুটবুদ্ধিরও প্রয়োজন।

চা পান করিয়া উপরতলায় রোগিণীর সংবাদ সইতে গেলাম। সামাজিক কর্তব্য পালন না করিলে নয়।

অধ্যাপক সোমের মুখ চিন্তাক্রান্ত। মালতী দেবীর অবস্থা খুবই খারাপ‌, তবে একেবারে হাল ছাড়িয়া দিবার মত নয়। দুটা ফুসফুসই আক্রান্ত হইয়াছে‌, অক্সিজেন দেওয়া হইতেছে। জ্বর খুব বেশি‌, রোগিণী মাঝে মাঝে ভুল বকিতেছেন। একজন নার্সকে সেবার জন্য নিয়োগ করা হইয়াছে।

স্বখাত সলিল। সহানুভূতি জানাইয়া ফিরিয়া আসিলাম।

নীচে নামিয়া আসিবার কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার ঘটক আসিল।

এবেলা ডাক্তারের ভাবভঙ্গী অন্য প্রকার। একটু সতর্ক‌, একটু সন্দিগ্ধ‌, একটু অন্তঃপ্রবিষ্ট। ব্যোমকেশের পানে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকাইতেছে যেন ব্যোমকেশ সম্বন্ধে তাহার মনে কোনও সংশয় উপস্থিত হইয়াছে।

কথাবার্তা সাধারণভাবেই হইল। ডাক্তার সকালে মহীধর বাবুর বাড়িতে গিয়া ফাল্গুনীর লাস দেখিয়াছিল‌, সেই কথা বলিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি দেখলেন? মৃত্যুর কারণ জানা গেল?’

ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আটন্সি না হওয়া পর্যন্ত জোর করে কিছু বলা যায় না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তবু আপনি ডাক্তার‌, আপনি কি কিছুই বুঝতে পারলেন না?’

ইতস্তত করিয়া ডাক্তারা বলিল‌, ‘না।’

ব্যোমকেশ তখন বলিল‌, ‘ও কথা যাক। মহীধরবাবু কেমন আছেন? কাল বিকেলে আমরা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ডাকাডাকি করেও কারুর সাড়া পাওয়া গেল না‌, তাই ফিরে এলাম।’

ডাক্তার সতর্কভাবে প্রশ্ন করিল‌, ‘কাঁটার সময় গিয়েছিলেন?’

‘আন্দাজ পাঁচটার সময়।’

ডাক্তার একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘কি জানি। আমিও বিকেলবেলা গিয়েছিলাম‌, কিন্তু পাঁচটার আগে ফিরে এসেছিলাম। মহীধর বাবু ভালই আছেন। তবে আজকে বাড়িতে এই ব্যাপার হল—একটা শক পেয়েছেন।’

0 Shares