চিত্রচোর

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আর রজনী দেবী! তিনি কেমন আছেন?’

ডাক্তারের মুখের উপর দিয়া একটা রক্তাভা খেলিয়া গেল। কিন্তু সে ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘রজনী দেবী ভালই আছেন। তাঁর অসুখ করেছে এমন কথা তো শুনিনি। আচ্ছা‌, আজ উঠি।’

ডাক্তার উঠিল। আমরাও উঠিলাম। দ্বার পর্যন্ত আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার কলকাতা যাওয়া তাহলে স্থির?’

ডাক্তার ফিরিয়া দাঁড়াইল‌, তাহার চোখ দুটা সহসা জ্বলিয়া উঠিল। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি এখানে শরীর সারাতে এসেছেন‌, গোয়েন্দাগিরি করতে নয়। যা আপনার এলাকার বাইরে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।’ বলিয়া গট্‌ গট্‌ করিয়া বাহির হইয়া গেল।

আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল‌, ‘ডাক্তার ঘটক এমনিতে খুব ভালমানুষ‌, কিন্তু ল্যাজে পা পড়লে একেবারে কেউটে সাপ।’

বাইরে মোটর-বাইকের ফট্‌ ফট্‌ শব্দ আসিয়া থামিল। ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল‌, ‘আরো পাণ্ডে সাহেব এসেছেন। ভালই হল।’

পাণ্ডে প্রবেশ করিলেন। ক্লান্ত হাসিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার কথা ফলে গেল। পরী উদ্ধার করেছি।’

ব্যোমকেশ তাঁহাকে চেয়ার দিয়া বলিল‌, ‘বসুন। কোথা থেকে পরী উদ্ধার করলেন?’

‘মহীধরবাবুর কুয়ো থেকে। ফাল্গুনীর লাস বেরুবার পর কুয়োয় ডুবুরি নামিয়েছিলাম। ঊষানাথবাবুর পরী বেরিয়েছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আর কিছু?’

‘আর কিছু না।’

‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পেয়েছেন?’

‘পেয়েছি। ফাল্গুনী জলে ডুবে মরেনি‌, মৃত্যুর পর তাকে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।’

‘হুঁ। অর্থাৎ কাল রাত্রে তাকে কেউ খুন করেছে। তারপর মৃতদেহটা কুয়োয় ফেলে দিয়েছে। আত্মহত্যা নয়।’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ফাল্গুনীর মতন একটা অপদার্থ লোককে খুন করে কার কি লাভ?’

‘লাভ নিশ্চয় আছে‌, নইলে খুন করবে কেন? অপদার্থ লোক যদি কোনও সাংঘাতিক গুপ্তকথা জানতে পারে তাহলে তার বেঁচে থাকা কারুর কারুর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ফাল্গুনী অপদাৰ্থ ছিল বটে‌, কিন্তু নিবোধ ছিল না।’

পাণ্ডে বিরস মুখে বলিলেন‌, ‘তা বটে। কিন্তু ভাবছি‌, পরটা কুয়োর মধ্যে এল কি করে? তবে কি ফাল্গুনীই পরী চুরি করেছিল? খুনীর সঙ্গে ফাল্গুনীর কি পরী নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি হয়েছিল? তারপর খুনী ফাল্গুনীকে ঠেলে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে?–কিন্তু পরীটা তো এমন কিছু দামী জিনিস নয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভাল কথা‌, ফাল্গুনীর গায়ে কি কোনও আঘাত-চিহ্ন পাওয়া গেছে?’

‘না। কিন্তু তার পেটে অনেকখানি আফিম পাওয়া গেছে। মদের সঙ্গে আফিম মেশান ছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝেছি। দেখুন‌, কি করে ফাল্গুনীর মৃত্যু হল সেটা বড় কথা নয়‌, কেন মৃত্যু হল সেইটেই আসল কথা।’

পাণ্ডে উৎসুক চক্ষে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘এ বিষয়ে আপনি কি কিছু বুঝেছেন ব্যোমকেশবাবু?’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল‌, ‘বোধ হয় কিছু কিছু বুঝেছি। আপনাকে আমার অনেক কথা বলবার আছে। কিন্তু আপনার শোনবার সময় হবে কি?’

পাণ্ডে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া দ্বারের দিকে টানিয়া লইয়া চলিলেন। বলিলেন‌, ‘সময় হবে। কিনা দেখাচ্ছি। চলুন আমার বাড়িতে‌, একেবারে রাত্রির খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরবেন।’

পাণ্ডে ব্যোমকেশকে লইয়া চলিয়া গেলেন।

আমি আর সত্যবতী রাত্রি সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তাস লইয়া গোলামচোর খেলিলাম।

ব্যোমকেশ ফিরিলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কি হল এতক্ষণ ধরে?’

ব্যোমকেশ স্বর্গীয় হাস্য করিয়া বলিল‌, ‘আঃ‌, মুর্গিটা যা রেঁধেছিল?’

ধমক দিয়া বলিলাম‌, ‘কথা চাপা দিও না। পাঁচ ঘণ্টা ধরে কি কথা হল?’

ব্যোমকেশ জিভ কাটিল‌, ‘পুলিসের গুপ্তকথা কি বলতে আছে? তবে এমন কোনও কথা হয়নি যা তুমি জান না।’

‘হত্যাকারী কে?’

‘পাঁচকড়ি দে।’ বলিয়া ব্যোমকেশ সুট করিয়া শয়নকক্ষে ঢুকিয়া পড়িল।

১০

বড়দিন আসিয়া চলিয়া গিয়াছে; নববর্ষ সমাগতপ্ৰায়। এখানে বড়দিন ও নববর্ষের উৎসবে বিশেষ হৈ চৈ হয় না‌, সাহেব-মোমেরা হুইস্কি খাইয়া একটু নাচানাচি করে এই পর্যন্ত।

এ কয়দিনে নূতন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই। মালতী দেবীর রোগ ভালর দিকেই আসিতেছিল; কিন্তু তিনি একটু সংবিৎ পাইয়া দেখিলেন ঘরে যুবতী নার্স রহিয়াছে। অমনি তাঁহার ষষ্ঠ রিপু প্রবল হইয়া উঠিল‌, তিনি গালাগালি দিয়া নার্সকে তাড়াইয়া দিলেন। ফলে অবস্থা আবার যায়—যায় হইয়া উঠিয়াছে‌, অধ্যাপক সোম এক হিমসিম খাইতেছেন।

শনিবার ৩০শে ডিসেম্বর সকালবেলা ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, আজ একটু রোঁদে বেরুনো যাক।।’

রিকশা চড়িয়া বাহির হইলাম।

প্ৰথমে উপস্থিত হইলাম নকুলেশবাবুর ফটোগ্রাফির দোকানে। নীচে দোকান‌, উপরতলায় নকুলেশবাবুর বাসস্থান। তিনি উপরে ছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া যেন একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন। মনে হইল তিনি বাঁধাছাদা করিতেছিলেন; কাষ্ঠ হাসিয়া বলিলেন‌, ‘আসুন।-ছবি তোলাবেন নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন নয়। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম‌, ভাবলাম আপনার দোকানটা দেখে যাই।’

নকুলেশবাবু বলিলেন‌, ‘বেশ বেশ। আমি কিন্তু ভাল ছবি তুলি। এখানকার কেষ্ট-বিষ্ট সকলেই আমাকে দিয়ে ছবি তুলিয়েছেন। এই দেখুন না।’

ঘরের দেয়ালে অনেকগুলি ছবি টাঙানো রহিয়াছে; তন্মধ্যে চেনা লোক মহীধরবাবু এবং অধ্যাপক সোম। ব্যোমকেশ দেখিয়া বুলিল‌, ‘বাঃ‌, বেশ ছবি। আপনি দেখছি। একজন সত্যিকারের শিল্পী।’

নকুলেশবাবু খুশি হইয়া বলিলেন‌, ‘হেঁ হেঁ। ওরে লালু্‌, পাশের দোকান থেকে দু’ পেয়ালা চা নিয়ে আয়।’

0 Shares